প্রচ্ছদ ফিচার করোনা বিশ্বে আমার দৈনন্দিন জীবন।

করোনা বিশ্বে আমার দৈনন্দিন জীবন।

0
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মোটামোটি ঘর বন্দি। সারাদিন ঘরে বসে টুকিটাকি কাজ করি। ঘরে অফিস নিয়ে আসলেও কাজের কাজ আসলে হয়নি। কাজে মন বসানো কঠিন। চতুর্দিকে শুধু অনিশ্চয়তা। ক্রিকেটের উইকেটের মতো প্রতিদিন করোনার লাশ সবার মতো আমিও গুনছি। বিশ্বের সর্বত্র একযোগে চলছে এই লাশের মিছিল। চারিদিকে চাপা আতঙ্কের চাপ দৃশ্যমান। ঘর থেকে বাহির হলেই মনে হয় না জানি কোন বিপদ বাহিরে অপেক্ষা করছে। একা একা যে রাস্তায় হাটতে ভয় হতো সেই একই রাস্তায় এখন মানুষজন দেখলে ভয় হয়। মনে হয় না জানি কি বিপদ নিয়ে আসছে। পকেটে টাকা আছে কিন্তু দোকানে যেতে ভয় হয়, না জানি দোকান থেকে কোন বিপদ নিয়ে আসি।
আমার ঘরে বউ, বাচ্চার সাথে রয়েছেন আমার মা। আশিউর্ধো বয়স। সবচেয়ে বেশি ভয় উনাকে নিয়ে। এমনিতে বয়সের কারণে রোগ বালাই লেগেই আছে আর তার উপর করোনার ভয়। মায়ের জন্য অধিকাংশ সময় বাহিরে যাওয়া উপেক্ষা করি। জানিনা কতদিন করতে পারবো। প্রতিদিন ক্লাইন্টের ফোন আসে – জিজ্ঞেস করেন অফিস কবে খুলবে? সবাইকে বলি সব কিছু ঠিক হলে অফিস খুলবো। তবে প্রয়োজনীয় কাজ গুলো আপাতত ঘরে বসে করছি। অনেক ক্লাইন্টের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলি। আবার ইদানিং টেলিফোনে ও কোর্টের অনেক কাজ সেরে নেয়া যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়া, ক্লাইন্ট দেখা, ফাইল ঘাঁটানো এবং দিন শেষে সকল টেনশন মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা গত ১৭/১৮ বছরের গড়ে উঠা অভ্যাস যেন নিমিষে পরিবর্তন হয়ে গেলো।
ছেলে-মেয়েরা বাসায় বসে থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠছে। প্রতিদিন জিজ্ঞেস করে বাবা স্কুল কবে খুলবে? বাহিরে কবে যেতে পারবো? উত্তর দেয়ার মতো কিছুই নাই, কারণ উত্তর আমারই জানা নাই। বলি বাবা ধৈর্য্য ধরো ইনশাল্লাহ শীঘ্রই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এটা যে নিছক সান্তনা জানিনা তারা বুঝে কিনা, তবে এছাড়া আমার কাছে যে আর কোন উত্তর নাই। আমার মা খবর নিয়ে খুব ব্যাস্ত ছিলেন। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে বসার রুমে বসে প্রথমেই বিবিসির কিংবা স্কাইয়ের খবর। স্বভাবতই ভাষার বিড়ম্বণায় সকল খবর বুঝেননা। আর সেজন্য শুরু হয় প্রশ্ন। আজ কতজন মানুষ মারা গেছে, ইউকেতে কতজন? আমেরিকাতে কতজন? ইউরোপে কতজন? রোগ কি কমতেছে না বাড়তেছে? এই আলোচনা চলে রাত ১০ টা পর্যন্ত। সেই সাথে ছোট মেয়ের সাথে চলে মায়ের রিমোট নিয়ে টানাটানি। ছোট মেয়ে ৫ বছর বয়স তার পছন্দ কার্টুন আর মায়ের পছন্দ নিউজ। ইদানিং লক্ষ্য করলাম খবর দেখতে দেখতে একরকমের মানসিক হতাশা ঘরের সবার মধ্যে কাজ করছে। তবে হতাশার চাপ মায়ের উপর একটু বেশি পড়েছে। এখন তাই ঘরে খবর দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। খবর দেখা বন্ধ করার পর সাময়িক ভাবে মায়ের মন খারাপ হলেও, লক্ষ্য করলাম হতাশা অনেকটা কমে গিয়েছে। আমি নিজেও অনেকটা ভালো বোধ করছি। এখন বাচ্চাদের সাথে প্লে-স্টেশনে গেম খেলি। লক্ষ্য করলাম বাচ্চাদের সাথে গেম খেলা খুব কঠিন কারণ তাদের চাইতে আমার রেসপনসিভ পাওয়ার কম, হয়তো বয়সের কারণে। আগে কাজের চাপে নামাজ গুলো সঠিক ভাবে করা হতোনা তবে ইদানিং সময়মতো পড়া যায়। অফিস নিয়ে তেমন চিন্তা করিনা।
এদিকে আমার শ্বশুর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। করোনা নয় দীর্ঘ দিন থেকে রোগের সাথে সাথে লড়তে লড়তে এখন প্রায় ক্লান্ত। সারাক্ষন উৎকণ্টায় থাকি কখন জানি কি হয়। এই লোকডাউনের সময় ১৭০ মাইল দূরে গিয়ে প্রতিদিন দেখা ও অসম্ভব। ভিডিও কলে সবার সাথে কথা বলা আর খুজ খবর নেয়া ছাড়া আপাতত কিছুই করার নাই। দোয়াকরি মহান আল্লাহ উনার নেক হায়াত দান করুন।
দেশ-বিদেশে রয়েছেন রয়েছেন পরিবার পরিজন সহ অসংখ্য বন্ধু-বান্দব। সময় পেলে টেলিফোনে কথা বলি খুজ-খবর নেই। ইদানিং রয়েছে হোয়াটস আপ আর ফেইসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে বন্ধু-বান্দবদের সাথে কথা বলার সুযোগ। সারাদিন বিভিন্ন গ্রূপ থেকে কল আসে কথা বলি সবার সাথে। দীর্ঘ দিন পর হয়তো ২০-৩০ বছর পর কোন কোন বন্ধুদের সাথে দেখা এবং কথা বলার সুযোগ হয়। একটা সময় ছিলো যাদের সাথে ২৪ ঘন্টা আটার মতো লেগে থাকতাম সময়ের পরিবর্তনে এখন কত দূরে। কিছু কিছু মানুষের কথা স্মৃতি থেকে প্রায় চলেই গিয়েছিলো। তাই শত হতাশার মাঝে ও ভালো লাগে।
প্রতিদিন ঘুমের আগে চিন্তা করি হয়তো আগামীকাল একটি সুন্দর সকাল হবে। মানুষের কোলাহল বাড়বে। আবার ফিরে যাবো সেই যান্ত্রিক জীবনে। শত হতাশা আর উত্কণ্ঠায় ভরপুর এইদিন গুলো হয়তো একসময় শেষ হবে। আবার সকাল হবে, লন্ডনের অলিগলি গুলো আবার হবে লোকে-লোকারণ্য। আবার আমার সেই চিরচেনা অফিস মুখরিত হবে ক্লাইন্টদের পদচারণায়। হয়তো সেদিন আমরা অনেকেই থাকবো আবার অনেকেই থাকবোনা। যারা বেঁচে থাকবে, তারা হবে কালের স্বাক্ষী। আজ থেকে হয়তো শত বছর পরে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের এই লোকডাউনে ঘরে বসে কাটানো দিনগুলোর কথা ভাববে আর ভয়ে তাদের গা শিউরে উঠবে।
সবাই ভালো থাকবেন এবং নিরাপদে থাকবেন।