প্রচ্ছদ আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিনি এক ছেলেকে কিডনি দান করলেন ইসরাইলি নারী

ফিলিস্তিনি এক ছেলেকে কিডনি দান করলেন ইসরাইলি নারী

0
অনলাইন ডেক্স: কিছুদিন পরই ইদিত হারেল সেগালের বয়স ৫০ হবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন একটি উপহার দেয়ার। নিজের কিডনি এক অপরিচিত ব্যক্তিকে উপহার দেবেন।
উত্তর ইসরাইলের কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক, একজন গর্বিত ইসরাইলি তিনি আশা করেন যে তাঁর এই সিদ্ধান্ত চিরন্তন সংঘাতের দেশে উদারতার এক নজির স্থাপন করবে। হলোকস্টে বেঁচে যাওয়া তাঁর প্রয়াত দাদার স্মৃতি তাকে এমন পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।যিনি তাকে অর্থবহ এবং ইহুদি ঐতিহ্য অনুসারে জীবনযাপন করতে বলেছিলেন যেখানে জীবন রক্ষার চেয়ে আর কোন গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য নেই।
তাই সেগাল এমন এক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন যারা দাতা ও গ্রহিতাদের সংযোগ স্থাপন করে। যার কিডনি দরকার তাকে নিজের কিডনি দিতে নয় মাসের ঐ প্রক্রিয়া শুরু করেন সেগাল।
সেগালের ক্ষেত্রে সেই কিডনি গ্রহিতা গাজা ভূখন্ডের ৩ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি এক ছেলে।
সেগাল হিব্রু ভাষায় ঐ ছেলেটিকে লেখেন, “তুমি আমাকে চেনো না, তবে শীঘ্রই আমাদের সম্পর্ক খুব কাছের হবে কারণ আমার কিডনি তোমার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হবে।”
ইসরাইলিদের সাহায্য গ্রহণ স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠতে পারে সেজন্য ঐ ছেলেটির পরিবার তাদের নাম প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করে।এক বন্ধু চিঠিটি আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন যাতে পরিবারটি বুঝতে পারে।
ইদিত হেরেল সেগাল, যিনি গাজা উপত্যকার এক ফিলিস্তিনি শিশুকে তাঁর একটি কিডনি দান করেছেন, তিনি ঐ ছেলেটিকে যে চিঠি লিখেছিলেন, আরবি অনুবাদ দেওয়ার আগে হিব্রুতে লেখা চিঠিটি ধরে আছেন হাতে। ১৩ জুলাই, ২০২১।
ইদিত হেরেল সেগাল, যিনি গাজা উপত্যকার এক ফিলিস্তিনি শিশুকে তাঁর একটি কিডনি দান করেছেন, তিনি ঐ ছেলেটিকে যে চিঠি লিখেছিলেন, আরবি অনুবাদ দেওয়ার আগে হিব্রুতে লেখা চিঠিটি ধরে আছেন হাতে। ১৩ জুলাই, ২০২১।
“আমি আন্তরিক ভাবে আশা করি যেন এই অস্ত্রোপচারটি সফল হয় এবং তুমি সুস্থ, দীর্ঘ ও অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারো।”
১১ দিনের যুদ্ধের পর সেগাল ঐ চিঠিতে লেখেন, “আমি ক্রোধ এবং হতাশাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি এবং একটি মাত্র জিনিস দেখতে পাচ্ছি। আমি শান্তি এবং ভালবাসার আশা দেখছি। আমাদের মতো যদি আরও কিছু মানুষ থাকে তবে লড়াইয়ের কোন কারণই থাকবেনা।”
সেগালের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে শুরু করে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য নির্ধারিত ১৬ জুন অবধি, সেগালকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তার সিদ্ধান্ত পরিবারের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তার স্বামী এবং তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়, ২০ বছর বয়সী পুত্র বিরোধিতা করে।সেগালের বাবা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন।
তাদের কাছে মনে হয়েছিল সেগাল অযথা নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছিলেন। পিতার পিতামাতাসহ ফিলিস্তিনের আক্রমণে তিনজন আত্মীয়কে হারানোর ফলে সেগালের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি ইশহারে পাহাড়ের উপর নিজের বাড়িতে বসে এক সাক্ষাৎকারে সেগাল বলেন, “আমার পরিবার এর বিরুদ্ধে ছিল। সবাই এর বিরুদ্ধে ছিল। আমার স্বামী, আমার বোন, তার স্বামী। এবং আমাকে সবচেয়ে কম যিনি সমর্থন করেছিলেন তিনি আমার বাবা।তারা ভয় পাচ্ছিল।”
ছেলেটির পরিচয় জানার পর বেশ কয়েক মাস সেগাল সব তথ্য নিজের মাঝে গোপন রাখেন।
সেগাল বলেন, “আমি কাউকে বলিনি। আমি মনে মনে বলেছিলাম কিডনি অনুদানের প্রতিক্রিয়া যদি এত রুঢ় হয় তবে বলা বাহুল্য যে এর চাইতেও রুঢ় প্রতিক্রিয়া হবে এটি শুনে যে এক ফিলিস্তিনি কিশোর এই কিডনি পাচ্ছে।
ইসরাইলের অস্তিত্বের বিরোধী ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবার পর ইসরাইল গাজার ওপর তাদের কঠোর অবরোধ বজায় রেখেছে।
এরপর থেকে এই তিক্ত শত্রুরা চারটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।খুব অল্প সংখ্যক গাজা নিবাসীদের ইসরাইলে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।বছরের পর বছর সংঘর্ষ ও অবরোধের কারণে গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পরে, মানবিক কারণে গুরুতর চিকিত্সার প্রয়োজনে অল্প সংখ্যক রোগীদের প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরাইল।
জেরুজালেমের একটি বেসরকারী সংস্থা মাতনাত চেইম এই বিনিময়ের সমন্বয়ের কাজটি করেছে। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী শারোনা শেরম্যান এ তথ্য দেন।
শেরম্যান বলেন, গাজার ঐ ছেলেটির বিষয়টি জটিল ছিল। পিতার সঙ্গে ছেলের কিডনির মিল পাওয়া যায়নি। প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার জন্য ছেলেটির পিতাকে বলা হয়েছিল তিনি যদি তাঁর কিডনি ইসরাইলে কোন গ্রহিতাকে দেন তাহলে তৎক্ষণাৎ তাঁর ছেলে কিডনি পাবার তালিকার শীর্ষে চলে যাবে।
একই দিনে তার পুত্র একটি নতুন কিডনি পেয়েছিল, পিতা তার নিজের একটি কিডনি দান করেছিলেন ২৫ বছর বয়সী ইসরাইলি দুই সন্তানের মাকে।
কোন কোন দেশে পারস্পরিক বিনিময়ের অনুমতি নেই কারণ দাতাকে জোর করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অঙ্গদানের পুরো নীতিটি এই নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে যে দাতারা তাদের নিজেদের ইচ্ছায় দান করবেন এবং এর বিনিময়ে কিছুই পাবেন না।
ইসরাইলে, বাবার এই দানকে দাতাদের আরও বেশি করে দান করার ক্ষেত্রে উৎসাহ হিসাবে দেখা হয়।
যে উপহারটি সেগালের পরিবারে এক প্রকার সংঘাত সৃষ্টি করেছিল, সেটি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অর্জন এনে দিয়েছে তাঁর জীবনে। তার কিডনি একটি ছেলের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে, দ্বিতীয় অনুদানের জন্ম দিয়েছে এবং বিশ্বের অন্যতম জটিল, ক্রমাগত যুদ্ধরত গোষ্ঠিগুলোর সদস্যদের মধ্যে নতুন সংযোগ স্থাপন করেছে। তিনি বলেন অস্ত্রোপাচারের আগে ছেলেটির সঙ্গে দেখা করেছিলেন সেগাল। তার বাবা-মার সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন।
সেগাল বলেন যে তিনি তার দাদাকে এমনভাবে সম্মানিত করেছেন যা পাঁচ বছর আগে তাঁর মৃত্যুর শোক সামলাতে সহায়তা করেছে।তিনি বলেন, অনুদানটি ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে।তিনি একবারের জন্যেও মতের পরিবর্তন করেননি। এবং অবশেষে তাঁর পরিবারও তাঁর এই উপহারের সিদ্ধান্তে তাঁর পক্ষে সায় দিয়েছিল।
তিনি বলেন যে তাঁর স্বামী ও সন্তানরা এখন আরও ভাল বোঝে।এবং সেগালের অস্ত্রোপচারের আগের দিন, তার বাবা ফোন করেছিলেন।
সেগাল বলেন, “তিনি কি বলেছিলেন মনে পড়ে না কারণ খুব কান্নাকাটি করেছিলেন।” তারপর বাবাকে জানিয়েছিলেন তার কিডনি এক ফিলিস্তিনি ছেলের কাছে যাচ্ছে।
এক মুহুর্তের জন্য নীরবতা ছিল। এবং তারপরে তার বাবা কথা বলেছিলেন, “ভাল, তারও বেঁচে থাকার প্রয়োজন।

কৃতজ্ঞতায়: ভয়েস অব আমেরিকা।