প্রচ্ছদ ফিচার বই হোক নিত্যসঙ্গী

বই হোক নিত্যসঙ্গী

0

নূরজাহান শিল্পী: ‘ভাল বন্ধু, ভাল বই এবং একটি শান্ত বিবেক এটি আদর্শ জীবন।“— মার্ক টোয়েন এর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়েই বলি , একজন মানুষের মনের ভেতরের অন্ধকারকে জ্ঞানের আলোয় দূর করার জন্য একটি বই যে বিরাট ভূমিকা রাখে তা পৃথিবীর আর কোন কিছুই রাখতে পারে না একজন মানুষ নিজে যখন জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ হয় তখন সে একটি দেশ কাল সীমানা অতিক্রম করে মানুষে- মানুষে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারে তার জ্ঞানের আলো। তার আলোয় পৃথিবী সুন্দর হয়ে ওঠে , ভূগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে, নিকট থেকে দূরে ,প্রান্ত থেকে প্রান্তে , যুগ থেকে যুগান্তর , কাল থেকে কালোত্তীর্ণ ,
এভাবে প্রতিটি মানুষ বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে তাদের চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত আমরা এক আলোকিত অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবী খুঁজে পাবো যা আমাদের স্বপ্নে বিরাজমান।

সেই সত্তর , আশি, নব্বই দশক মানেই ছিল বই পড়ার দশক | আমাদের মা, নানী, দাদীরা তারপর আমরা | আমাদের ৮০ দশকের যারা নির্ভেজাল বিনোদন কিংবা অবসর যাপনের একমাত্র মাধ্যম ছিলো বই পড়া ,অলস দুপুর বিছানায় গা এলিয়ে বই আমাদের উজ্জীবিত করে তোলতো নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে পড়ার মধ্যে আমরা অন্য রকম এক আনন্দ পেতাম |
সেই দশকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে কিংবা চায়ের দোকানে তরুণদের সাহিত্য আড্ডা বসত। সেসব আড্ডায় গল্প হতো শিল্প, সাহিত্য, রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। ক্রমে সে ধরনের আড্ডায় ভাটা পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে; ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে খুব জনপ্রিয়। বই পড়া কমেছে, কমেছে বইয়ের উপযোগীতা।

বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র এখন শিক্ষিত তরুণ সমাজের দিনরাত্রির সঙ্গী। মননশীলতা চর্চার অভাবে সুকুমার বৃত্তিগুলো শৈশব যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রথম ধাপ হলো মানুষের শৈশব আমরা আমাদের সেই শুরুটা বই দিয়েই করেছি তখন সবার শৈশব ছিল রঙিন।

আমাদের সুযোগ ছিল প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে খেলাধুলাসহ পুকুরে সাঁতার কাটা ,ঘুড়ি উড়ানো ,সাইকেলে স্কুলে যাওয়া ,ফুটবল ,ক্রিকেট ,ব্যাডমিন্টন ,হাডুডু ,কানামাছি ,গোল্লাছুট এসবে আমরা বেড়ে উঠেছি যা আজকালকার প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প।

আজকাল সব কিছু সংকুচিত হয়ে এসেছে | জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় খেলাধুলার বিরাট মাঠগুলো অট্রালিকায় পরিণত হয়েছে । পাঠ্যপুস্তক ভরে বিদ্যালয় শেষে কোচিং সেন্টারে এক শিক্ষক থেকে অন্য শিক্ষকের কাছে ছুটা নির্মল শৈশব যেন হারিয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে । আমাদের সময় পাড়ায় পাড়ায় ছুটো ছুটো পাঠাগার ছিল ,ছিল সংগঠন। যার কাছে কাছে ১০/১২টা বই ছিলো উনি তা সবাইকে পড়তে দিতেন। আমরা সেই বইগুলো পড়ার পর আবার ফেরত দিতাম।

বর্তমানে পাঠাগারের জায়গা বিলাসী ফার্নিচারে দখল করেছে । বইয়ের জায়গা নিয়েছে প্রযুক্তির গেইম গুলো। এখনকার প্রজন্মের মানসিক বিকাশ যথেষ্ট নয় তারা ফেসবুক ,টুইটার , ইনস্ট্রাগ্রম ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সর্বগ্রাসী প্রভাবের মধ্যে বই পড়ার সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । পাঠাগারগুলোতে হতাশা ব্যাঞ্চক শূণ্যতা। স্কুলের ব্যাগ এখন এতটাই ভারী, সিলেবাসের বিরাট বোঝা বহন করতে গিয়ে শিশুরা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ওদের আর বই পড়া হয়ে উঠে না।

সুকুমারবৃত্তি গুলো ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। ইদানিং যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠায় শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়ে বাবা মায়েরা বাইরে কাজে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন । যার ফলে বাচ্চারা অনলাইনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। সৃজনশীল কাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । বাচ্চাদের আমরা ছোটবেলা থেকে যা শেখাবো তারা তাই শিখবে ।একটি বই পারে মানসিক ব্যাধি থেকে একজন মানুষকে সুস্থ রাখতে । বর্তমান প্রজন্ম মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে যাওয়া, বিজাতীয় সংস্কার আমাদের ওপর এত বেশি প্রভাব ফেলেছে
একটা প্রজন্ম ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তাই একটি বই হতে পারে আত্মশিখনের শ্রেষ্ঠ সহায়ক বিনোদন থেকে শিক্ষা ,অন্ধকার থেকে আলো। বই অবসর যাপন থেকে নিঃসঙ্গতা দূর — বই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন হতে পারে ।

একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়। “-সে কথাই বলেছেন অস্কার ওয়াইল্ড। তাই আসুন আমরা আবার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি এই প্রজন্মের তরুণদের ভেতর বইয়ের প্রতি নেশার বীজ বপন করি , ফিরিয়ে আনি বাসযোগ্য বসুধা।

বই পড়ার অভ্যাস করার পদ্ধতি :
মনে রাখবেন, যদি আপনি শুধু পাঠ্যবই পড়েন, তবে আপনার জ্ঞান ব্যষ্টিক। আর যদি পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নানা ধরনের বই পড়েন, তবে আপনার জ্ঞানের পরিধি হবে সামষ্টিক। তার জন্য প্রচুর বই পড়া চাই যাদের বই পড়ার অভ্যাস নেই, তাদের জন্য বই পড়ার অভ্যাস গঠনের কিছু টিপস তুলে ধরা হলো..

-প্রথমে একটি সময় বের করুন। আপনার সারা দিনের ব্যস্ততার মধ্যে থেকে একটি একটি নির্দিষ্ট সময় খুঁজে নিন। প্রতিদিন এই সময় শুধু বই পড়ার জন্য রেখে দিন।
-দৈনিক একই সময়ে বই পড়ুন। দেখবেন আস্তে আস্তে আপনার বই পড়ার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে তখন সেই সময়ে বই পড়তে না পারলে অপূর্ণ মনে হবে আপনাকে।
-প্রথম প্রথম বড় গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালো লাগবে না বা পড়তে মন বসবে না। সেজন্য মজার মজার বইগুলো পড়ুন। যেমন, আপনি যদি প্রযুক্তি ভালোবাসেন, তবে সাইন্স ফিকশন বই পড়ুন। যারা রোমান্টিক ধাঁচের তারা সে ধরণের বই পড়ুন |
-কবিতা প্রেমীরা কবিতার বই পড়তে পারেন
-যার যে বিষয় ভালো লাগে, সেই বইগুলো প্রথমে পড়া শুরু করুন। এতে বই পড়ার আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে।
-আজ বইয়ের কমপক্ষে কত পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করবেন, আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখুন। এতদিনের ভেতরে এই বই শেষ করব। এই রকম টার্গেট নিয়ে বই পড়ুন। দেখবেন বই পড়ার যেমন শখ তৈরি হবে, তেমনি অভ্যাসেও পরিণত হবে।
-আপনার গৃহকোণে খুব ছোট্ট একটা লাইব্রেরির মতো করে গড়ে নিন আপনার সাথে সাথে দেখবেন আপনার বাচ্চাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।
– একা কোথাও লম্বা জার্নিতে যাচ্ছেন,ব্যাগে সবার আগে প্রিয় বইটি ঢুকিয়ে নিন। ট্রেনে-বাসে বসে বই পড়ুন একাকিত্ব দূর হবে, বই পড়ার প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। ভার্সিটিতে যাবেন, অফিসে যাবেন বাসে বসে সময় নষ্ট না করে বই পড়তে পারেন।
কাজের লাঞ্চ ব্রেক এ আছেন কফির চুমুকে বইয়ে চোখ বুলিয়ে নিন ।

আজকাল অনলাইনে আপনি যে কোনো বই যে কোনো সময় ক্রয় করতে পারবেন। ঘরে বসে বই কিনতে পারেন। বই মেলায় গিয়ে নিজে দেখে বই কিনতে পারেন | আবার ই-বুকও পড়তে পারেন সোস্যাল মিডিয়ায় অযথা সময় নষ্ট না করে। নিজেকে ভালো রাখুন সর্বাত্মক ভাবে আর নিজেকে ভালো রাখার জন্য বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর নেই। বই আত্মার খোরাক সব থেকে নির্ভেজাল বন্ধু তাই বইকে সঙ্গী করে নিন | সুইফট বলেছেন ,বই মস্তিষ্কের সন্তান। তাই মস্তিষ্ক ভালো রাখুন গোটা শরীরটাই ভালো থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিলেতে বাঙালী দবির চাচা প্রেরণার উৎস
পরবর্তী নিবন্ধলণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের অমর একুশের অনন্য আয়োজন ও সেই স্মরণীয় সন্ধ্যা: একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি