মো: আবদুস সালিম: রানিয়া আল আবদুল্লাহ। তিনি জর্দানের রানী। ১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির রানীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার জন্ম কুয়েতে এক ফিলিস্তিন পরিবারে ৩১ আগস্ট ১৯৭০ সালে। প্রায় ৪৭ বছর বয়সে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, অর্থনীতি, সম্প্রীতি প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। জর্দানেই তার কর্মজীবন শুরু, সেখানে রাজকুমার আবদুল্লাহর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। জর্দানের বর্তমান রাজার সাথে তিনি বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯৩ সালে। এর পর থেকেই রানী তার কাজে আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন, যুব, আন্তঃদেশীয় মতবিনিময় ও ক্ষুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে কাজ করার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হতে থাকেন বিশ্বে। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক বেশি আগ্রহী তিনি। রানী সরকার থেকে অনেক ধরনের পুরস্কারেও ভূষিত হন।
একসময় তিনি কুয়েতের জাব্রিয়ায় ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। পরে কায়রোতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসা প্রশাসনে ডিগ্রি অর্জন করেন। সিটি ব্যাংকে মার্কেটিং বিভাগে কিছু দিন কাজ করার পর আম্মানে অ্যাপল ইনক কোম্পানিতে কাজ করেন। বিয়ের পর থেকে রানী জর্দান এবং সে দেশের বাইরে বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে তার পদবিকে ব্যবহার করতে থাকেন। মে ২০০৭ সালে দেশটির প্রথম আন্তঃকর্ম শিশু জাদুঘরের চেয়ারপারসন ছিলেন। জাদুঘরের উদ্দেশ্য ছিল শিশু ও তার পরিবার যাতে আজীবন শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা লাভে উৎসাহ পায়। এরপর রানী জর্দানের ৫০০ সরকারি-বেসরকারি স্কুল পুনঃসংস্কারের উদ্যোগ নেন এবং এ ব্যাপারে পাঁচ বছরব্যাপী এক পরিকল্পনা হাতে নেন। এরপর তিনি ‘রাজকীয় স্বাস্থ্যসচেতন’ নামক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন হন।
তার প্রথম সাহসী উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি হলো জর্দান রিভার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৯৫ সালে এ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ছেলেমেয়েদের কল্যাণগুলোকে রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত করা। এর আরো কাজ হলো শিশুদের জরুরি চাহিদা মিটিয়ে শিশু নির্যাতন দমনে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নেয়া। তিনি এ-সংক্রান্ত কিছু ব্যর্থতার (সরকারি-বেসরকারি) কারণও বের করেন।
কুইন রানিয়া বলেন, যুবকদের প্রকৃত শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি করবে দক্ষ জনশক্তি। ভবিষ্যৎ এতিমদের জন্য আল-আমান তহবিল গঠন করেন এবং বিদেশে জর্ডানি শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ১৯৯৯ সালে ইনজাজ আল-আরব নামে শিশুদের সুরক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব হলে তিনি তাতে সমর্থন জোগান এবং ২০০১ সালে জর্দানে শিশু রক্ষায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘জুনিয়র অ্যাচিভমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। ইনজাজ আল-আরবের সফলতাকে কেন্দ্র করে এবং দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিভিন্ন উদ্যোক্তার সাথে মতবিনিময় ও সভাপতিত্ব করেন। ইনজাজ আরাবিয়ার ধারণাকে কেন্দ্র করেই ২০০৮ সালে তিনি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম গঠন করেন এবং ১০ লাখ আরব যুবককে ক্ষমতায়ন করার অভিযান পরিচালনা করেন।
শিশু ও যুবকদের বিষয়কে তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইউনিসেফ রানিয়াকে বৈশ্বয়িক নেতৃত্বদানে আমন্ত্রণ জানায়। শিশুকল্যাণের উদ্দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতাদের সাথে কাজ করেন। রানিয়াকে ইউনিসেফের প্রথম শিশুবিষয়ক ‘প্রসিদ্ধ অ্যাডভোকেট’ হিসেবে ভূষিত করা হয়। তাকে ইউনাইটেড ন্যাশনস গার্লস এডুকেশন ইনিশিয়েটিভের অনারারি গ্লোবাল চেয়ার পদও দেয়া হয়।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষা অভিযান কর্মসূচিতে দক্ষিণ আফ্রিকা, জোহানেসবার্গের বিভিন্ন শহর এবং সুয়োটোতে যোগদান করেন। অন্য নারীদের সাথে সাহিত্যকে উৎসাহিত করার জন্য ছোটগল্প পড়ার ব্যাপারেও উৎসাহ দেন।
সেখানে ‘মাহা অব দ্য মাউনটেনস’ গ্রন্থখানি দান করেন। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নামক অভিযানে যোগদান করেন লন্ডনে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলারদের সহায়তায়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন, ফিফার প্রেসিডেন্ট শেপ ব্ল্যাটার, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাসহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে যোগাযোগ রেখে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা অভিযান পরিচালনা করেন। এমনকি বেদনাকে বিজয়ে পরিবর্তন করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি সব রাজনৈতিক নেতাকে তাদের সাহায্যের ব্যাপারে ওয়াদা পূরণের আহ্বান জানান।
আরব বিশ্বে ফোর্বস ম্যাগাজিনে ২০১১তে তাকে বিশ্বের ১০০ জন ক্ষমতাশীল নারীর একজন হিসেবে প্রকাশ করা হয়। সারা বিশ্বের সহিষ্ণুতা ও গ্রহণযোগ্যতা সাংস্কৃতিক জগতেও থাকবেÑ এই মতবাদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ইউটিউব ব্যবহার করেন সাংস্কৃতিক মতবাদ আদান-প্রদানের জন্য এবং সারা বিশ্বে মুসলমানদের, বিশেষ করে আরব বিশ্বে মানুষের ‘ছাঁচে ঢালা রূপ’ পরিবর্তন করার জন্য যুবকদের প্রতি আহ্বান জানান। গণমাধ্যমে তিনি ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামে নারীর মর্যাদার ওপর ভ্রান্ত ধারণার বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। আন্তঃমহাদেশীয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ কর্মের জন্য কাউন্সিল অব ইউরোপ থেকে ‘নর্থসাউথ প্রাইস’ প্রাপ্ত হন। একই সাথে প্রথম ইউটিউব ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড পান। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পিস মেকার অ্যাওয়ার্ড পান। তিনি জর্ডানের জেড সিতে ‘ইয়ং গ্লোবাল লিডার্স সামিটে যোগদান করেন। উদ্দেশ্য হলো এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার জন্য স্থানীয় মাদরাসাভিত্তিক বিদ্যালয়, জর্দান রিভার ফাউন্ডেশন ও আনুষঙ্গিক সংস্থাগুলোতে ভ্রমণ করা। ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশন বোর্ড অব ডাইরেকটর্সে যোগদান করেন। ওই ফাউন্ডেশন বিশ্বের সবচেয়ে যাঁতাকলে পিষ্ট সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারকে ব্যবহার করে এবং জনগণ যেখানে পৌঁছাতে না পারে সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার জন্য শক্তিশালী সমর্থন জোগায়।
রানী রানিয়া আল আবদুল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির বা আইসিআর পর্ষদ সদস্য ও জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ তৎপরতাবিষয়ক সংস্থাগুলোর একজন দূত। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালং (উখিয়ার) রোহিঙ্গাশিবির পরিদর্শন করেন। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা, মুসলিম নারী ও পুরুষদের কাছে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে হত্যা, নির্যাতন, অত্যাচার ইত্যাদির বর্ণনা শোনেন রানী। শুনে রানী বলেন, ‘জন্মভূমি ও দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে জাতি নিধনের বর্বরতম ঘটনা। মিয়ানমার মানবাধিকারের কোনো কিছুই তোয়াক্কা করছে না। এ অবস্থায় বিশ্বসম্প্রদায়ের অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে তাদের দুর্দশার অবসানে। মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তাদের ওপর নির্যাতন, হত্যা বন্ধ করাতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে ফের নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারে সে দিকে সজাগ হতে হবে বিশ্বনেতাদের।