আতাউর রহমান মিলাদ
কেমন করে কাটছে প্রবাস জীবন? এ প্রশ্নটা কোন প্রবাসীকে করতে নেই। উত্তরটা নিষ্ঠুর, নির্মম। আন্তত যারা দেশ ছেড়ে বড় হয়ে এসেছেন তারা জানেন প্রবাস জীবনের যন্ত্রণা। না সে যন্ত্রণা ক্ষুধার নয়, অভাবের নয় কিংবা অক্ষমতার নয়। যন্ত্রণা মনে। ফেলে আসা সময়ের দগদগে ঘা যন্ত্রণা দেয়। মধুময় শৈশব, চঞ্চল কৈশোর কিংবা যৌবনের অর্থহীন সময়গুলোও খুব অর্থপূর্ণ মনে হয়। বৈকালিক আড্ডা, কলেজ জীবনের ফালতু রাজনীতি, গালর্স স্কুলের মেয়েদের রিক্সার পেছনে ব্যর্থ চক্কর মনের ভেতর সময় অসময়ে চক্কর দিয়ে উঠে। বাড়ীর দক্ষিণ পাশের কাঁঠাল গাছটার জন্য, প্রিয় সুপারি গাছটার জন্য, দুধেল গাভিটার জন্য মন উতলা হয়। প্রিয় শহরের জন্য, প্রিয় বন্ধুর জন্য, প্রিয় স্মৃতিগুলোর জন্য কষ্ট বাড়ে।
প্রতিটি প্রবাসীই মনে প্রাণে দেশের কথা ভাবেন। যত দূরে যায় দেশটা ততো কাছে চলে আসে। দেশের ভালোমন্দ খবরগুলো জানার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। ভিন্ন দেশে বাস করে স্বদেশটাই লালিত হয় বুকের ভেতর। দুই যুগ এই বিলেত বাস করেও এই দেশটাকে আপন ভাবতে পারিনি। বাংলার মাটি, জল, রস, রুপ, গন্ধ লেগে থাকে মনে। প্রবাস জীবনের নানা অনুভূতি বিভিন্নভাবে জায়গা করে নিয়েছে আমার কবিতায়। শুরুর কবিতাটি ছিলো এ রকম-
‘অনেকদিনের চেনা শহর তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি চলে/ বুকের ভেতর নীল বেদনা তুই যে আমার আপন ছিলে…যাচ্ছি চলে যাচ্ছি চলে সবকিছুকে পেছনে ফেলে/ এই শহরের তেলে জলে মানুষ হওয়া একটি ছেলে… রইলো মায়ের আঁচল ভালোবাসার নীরব সেতু/ রইলো পড়ে নঁকশীকাঁথা রং বেরংয়ের ছয়টু ঋতু…[ যাচ্ছি চলে উড়ছে ধুলো]।
প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে উঠে যে জীবন প্রার্থনা করি তা কল্পনাই থেকে যায়। আমি চাই সবকিছু স্বপ্নের মতো হোক- ‘ স্মৃতির উজানে আছে নৈ:সর্গিক কোলাহল। পাখিডাকা মায়াভোর, তারুণ্যের স্বপ্নভরা রোদেলা দুপূর, সবুজ ঘাসের মাঝে বিলিকাটা হলুদ বিকেল, অমুদ্রিত সন্ধ্যার আবছা পরশ কিংবা রাতের সংসারে সব যৌথ কারুকাজ…এক জীবনের গ্রহণে বর্জনে যেটুকু সঞ্চয়, মুঠোভর্তি রোদের ঢেউ, ঢেউ তোলা ধানের মাঠ, মাঠ ঘাট পেরিয়ে সুনীল আকাশ, আকাশে ওড়ার প্রজাপ্রতি ডানা, সকলি চিহিৃত হোক নিজস্ব খাতিয়ানে।'[জন্মদিনের কাব্যগাঁথা]।
কবিতার চাওয়ার মতো আমার নিজস্ব স্বপ্নগুলো জীবনের চারপাশে উড়াউড়ি করে। একান্তে পাওয়ার ইচ্ছায় লাফ দেই। হাতের নাগালে আসে না। কষ্ট বাড়ে। জন্মগ্রামের মমতায় বাঁধা পড়ে আছি। সাপের মতো খোলস পাল্টাতে পারি না। বারবার ঘুরে ফিরে আমার কবিতায় জন্মের চিৎকার শুনি- ‘সত্যের মতো সুন্দর দিনগুলি হাতছানি দেয় মনু’র তীর ঘেষে বেড়ে উঠা সেই গ্রাম/ টানে; জীবনের ঘুড়ি টানে স্মৃতির নাটাই/ বোধের পলিতে জমা গোধুলি লগন/ বাঁশঝাড় উঁকি দেয়া মায়াবতী চাঁদ…/’ [এক টুকরো স্মৃতি]।
এ আমার জন্মগ্রামের সফল চিত্রায়ণ-‘ যমজ বোনের মতো নদী ও মায়ায় চিরচেনা গ্রাম/ সবুজ বাহু বাড়িয়ে ডাকে পূর্বের সুরুজ, কৃষকের নোনাঘাম/ শিহরিত ধানপাতা, গরুদের মাঠনৃত্য, পাখিদের গান/ ঘাসফরিং বয়ে আনে জন্মের রঙীন দিন, বসন্তের হলুদ প্রাণ…’ মনু’র কোমরে বাঁধা জন্মের তাবিজ, বুকে মৌলভী বাজার শহর/ শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে জন্মগ্রাম শ্রীরাইনগর…[জন্মগ্রাম]। ‘এইসব ভেজা গন্ধের ভেতর একটি গ্রামের আলপথে/ আমি বহুবার শুনিয়েছি শস্যবোনার নেপথ্য গান…[ভুল প্যাচাল] সেই গান আর শুনিতে পারি না আজ। যে গ্রাম আজ আমি দুইযুগ আগে ফেলে এসেছি, সেই গ্রামটাও আগের মতো নেই। সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া। চিনতে পারি না। ফেলে আসা গ্রামটাকে খঁজে ফিরি। ফিরে যেতে চাই দুইযুগ আগে।শহরের ছোঁয়া লেগে জন্মগ্রাম তার চরিত্র বদলে গেছে। আমার কষ্টরা কবিতায় আশ্রয় নেয় এভাবে-‘চল্লিশের জন্মগ্রাম অনূদিত হয় অচিন ভাষায়/ পর্যটন মন খুঁজে শৈশবের ভাঁজ করা শিল্পিত পথ… গ্রামের ঘোমটা খুলে পরেছে নগর নোলক/ আমি সেই জন্মগাঁথা অবুঝ বালক, খুঁজে ফিরি/শৈশবের ঘাসকাটা ভোর আর ভোরের ফরিং…[ভোরের ফরিং]।
জন্মের চোখ মেলে দেখেছি যে নদী তার নাম মনু।শীতের নদীতে নেমে মেখেছি জল করতলে। জীবনের অর্ধেক পৃষ্ঠাজুড়ে এই মনু। তাকে আড়াল করতে পারি না কোনভাবে। এই নদীর সাথেই জীবন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। শব্দে শব্দে তাই প্রতিদিন বেড়ে যায় মনুবন্দনা- ‘মনুই আমার পরম কুটুম। প্রতিদিন ধারন করি জলের বয়স। ছুঁয়ে যাই মনুর দু’কোল। ঢেউয়ের ভাঁজ খুলে মেতে থাকি জলগল্পে। জেনে নেই বয়ে চলা গোপন রহস্য, জলের ধারাপাত, আলোর কুশল। সঞ্চয়ে জমা করি পড়শি ভ্রমন…[মনু্ক্রান্ত অস্থিরতা]।
মনু’র বাঁধ ঘেষে বেড়ে উঠেছে অনেক বসত। ওরা বানে ভাসা মানুষ। স্রোতের টানে বেঁচে থাকার তাগিদে ভেসে এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। গৃহহীন মানুষগুলো আশ্রয় নিয়েছে মনু’র বাঁধে। এখানে কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছে ভাসান সুখ, কেউ হারিয়েছে অনেককিছু- মনু’র কাধেুঁ কেউ কেউ খুঁজে পায় ভাসান সুখ। নিজেকে ভাসিয়ে রাখে জলে ও জলের অবাধ্যগ্রাসে। ওরা ভাসে জীবনের আদিম চাওয়ায়্ ওরা সাজে, পসরা সাজায় প্রতিদিনের হাসিকান্না মনু’র বাঁধ ঘেষে জমে থাকে অতৃপ্ত মানুষের ঘরভাঙা সুখ… বালিকার তলপেঠে নিষিদ্ব আগুন জ্বলে জননীন নি;শ্বাস আর্শিবাদে… যৌবনের পয়ার ছন্দে শিখে নাগরিক ধারাপাত…[ভাসান সুখ]।
সেই সাতাশিতে দেশ ছেড়ে চলে এসেছি। তখন এম সি কলেজের অর্নাসের ছাত্র ছিলাম। হঠাৎ করে বন্ধুমুখর কোলাহল ছেড়ে খুব খারাপ লাগছিলো। সৌভাগ্যক্রমে দীর্ঘগ্যাপ শেষে এখনো অনেকের সাথে সুসম্পর্ক রয়ে গেছে। স্মৃতির খাতায় এগুলোও জমা হয়। দীর্ঘ সময় শেষে বেঁচে থাকা এই সম্পর্কগুলো আনন্দের ঢেউ তুলে-‘ সময়টা যে দাঁড়িয়ে নেই আমার শীতের সাতাশিতে/ তোমার খোঁপায় লাফায় না ফুল রং বেরংয়ের ফিতে/ পাকঘরে আজ বউ এসেছে পাক ধরেছে চুলে/ তোমার মনে আমার কথা রইলো কোনো সে ভুলে?… আমরা কি আর ফিরে পাবো ঝগড়ামুখর দিন/ শিরিষতলায় চ্যাপ্টাঘাসে ভালোবাসার ঋণ/ সময়টা যে দাঁড়িয়ে নেই আজ এমসি কলেজ মাঠে/ আমরা আজও বন্ধু আছি মেঘের পত্রপাঠে…[সাতাশির শীতে]।
দেশ ছেড়ে চলে আসার পর আমার সব সময়ের সহযাত্রি কবি মুজি রহমানকে খুব মিস করি। শিল্প সাধনার সূচনালগ্নে একসাথে ফেরি করেছি অনেক স্বপ্ন। যাযাবর স্বপ্নগুলো ভোগায়। ছায়ার মতো তার সাথে থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির হাটে ঘুরেছি। আধুনিক প্রেসে নিজ হাতে কম্পোজ করে, কাঠ খোদাই করে প্রচ্ছদ তৈরি করে বের করেছি অনেকগুলো সাহিত্যে কাগজ। সেই মুজিব আমি দেশ ছাড়ার আগে কবিতা থেকে নির্বাসিত হয়ে যায় দীর্ঘকাল। শিল্পের পথ ছেড়ে ব্যবসার হাল ধরে। হয়ে যায় পুরোপুরি ব্যবসায়ী। আমার কবিতায় সে আসে এভাবে-ই-‘ বইয়ের মতো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন শেষে জীবনের ও মূর্ণমুদ্রন হয়। আমার বন্ধু মুজিব এখন কবিতা লিখেনা, মহাজনি ভঙ্গিতে দোকানের জমাখাতা লিখে। একটি কবিতার সমৃদ্ধ জোরালো সংখ্যা। একটি শিল্পমান কাগজে বিয়োবার যন্ত্রণা ভুলে প্রতিদিন সিঁড়ি বেয়ে আকাশকে ঘুঙুর পরায়। চাঁদের বাড়ি দখল নিয়ে বন্ধ্যাতর্ক শেষে বন্ধুরা ফিরে না মুদির দোকানে…মুজিব কড়া গুণে সময় চিহেৃ…[জীবনের পুণমুদ্রণ]। আজ দুই যুগ পর মুজিবও বিলেতবাসী এবং আনন্দের কথা আবারো লিখতে শুরু করেছে। ‘এসো দু;খ রাত জাগি’ ও ‘তোমার বাড়ির ছায়া’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
দীর্ঘদিন বিলেতবাসের ফলে এখানকার জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। এখান থেকে সহজে ফেরার পথ নেই। সংসারের ডালপালা বর্ধিত হয়ে একটা ভিন্নরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। একটা নির্ধারিত সময়ের ভিতর দিয়ে আমরা সময় পার করছি। বেড়ে উঠেছে পরবর্তী প্রজন্ম। বিলেত আমার দেশ না হলেও তাদের দেশ এটা অস্বীকারের উপায় নেই। ওরা এই সমাজের প্রতিনিধি। কিন্তু আমরা যাদের শেকড় প্রোথিত বাংলার মাটিজলে, কখনো এই সমাজকে নিজের মনে করতে পারি না। অথচ এ সমাজের বড় অংশ আমারও। তাই তো কবিতায় উচ্চারিত হয় অসহায় ক্রন্দন- ‘আমরা এখন পরের ঘরে পোষাপাখি/ ওদের ভাষায় কথা বলি, গদ্য পড়ি…ফিরতে চাইলেও হয় না ফেরা আর/ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শুধু আকাশ দেখি/ প্রশ্নরা সব মেঘের মতো হাওয়ায় ওড়ে/ শেকল ছেড়া গাছঠা কেবল নুয়ে পড়ে/ ঝড় ঝাপটায় বুকটা কাঁপে/ আরেক মানুষ জেগে ওঠে সবার ভেতর/ হাত বাড়িয়ে সলতেটাকে উসকে দেখি/ আত্বীয় সব স্বজনেরা অনেক দূরে/ এই প্রবাসে আমরা তখন প্রহর গুণি ঘরে ফেরার/ হয় না ফেরা/ জীবনটা যে মিহিন সূতোয় সেলাই করা…[সব পাখি ঘরে ফেরা না]।
এই বিলেতের উন্নত শহরে থেকেও মন ভালো থাকে না। আমার অস্থিত্ব খুঁজে পা্ই না কোথাও। প্রাণের স্পন্দন নেই। নদীর মতো বয়ে চলা জীবন। এক জীবন বহন করা দুই জীবনের ভার। জেগে ওঠে না মুখর ঢেউ। চতুর স্বপ্নরা চারপাশে ঘুরে ফিরে যায়। এই শহরে প্রতিদিন খুঁজি পায়ের চিহৃ- ‘এই শহরের কোন বাড়িটা আমার বাড়ি/ পাই না খোঁজে ভীড়ের মাঝে পায়ের চিহৃ হারিয়ে গেলে/ খুঁজি রোজ-ই/ কোথায় যেন মনটা বাঁধা আগলে রাখা/ সবুজ মাঠে/হাতের কাজে সময় কুড়াই ব্যর্থ অকুল/ জীবন পাঠে…[কল্পচতুর]।
একসময় ভুলে যাই সবকিছু। মুছে ফেলি পুরোনো অধ্যায়। অভিমানে কেটে ফেলি সকল বন্ধন। বেহিসেবি যুবকের অাত্মঅভিমানি সুর- ‘স্মৃতির পাখিরা উড়ে যায় দূর/ মুছে যায় পালকের চিহৃ। মনে রাখে না অভিমানী যুবক। পায়ের ছাপ, জন্মের শেকড় বাকড়। ঝরা পাতায় দু:খ, ভালোবাসার ব্যর্থগান। যুবক অভিমানে ভুলে যায় চেনা আঁল, ধূলোভরা সমূহ পথ, মনু’র জলে জমা কৈশরের স্রোত, বালিকার বুকে আঁকাশ পথ..[স্মৃতিহীন অচিন অধ্যায়]। কিন্তু অভিমান বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। মাটির টানে ফিরিয়া রাখার উপায় নেই। কারণ- ‘জুতা পরলেই যায় না ঝরে তলার মাটি/ মাটির দেহ মাটির মায়ায় বান্ধা আছে খাঁটি। ‘যতোই দূরে থাকি বুকেতে ধারণ করি বাংলাদেশ। এ যে আমার অহঙ্কার। ‘ঘষেমেজে জীবনটারে রাখি যতোই পরিপাটি/ বেলাশেষে ঘরের ছেলে আঁকড়ে জনম মাটি…[ পরবাস]