প্রচ্ছদ সফল নারী ইরানে প্রথম নারী উপরাষ্ট্রপতি মাসওমেহ এবতেকার ভিন দেশ

ইরানে প্রথম নারী উপরাষ্ট্রপতি মাসওমেহ এবতেকার ভিন দেশ

0
মো: আবদুস সালিম: মাসওমেহ এবতেকার। ইরানের এই নারীর আরেক নাম নিলোওফার এবতেকার। তার জন্ম ১৯৬০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ইরানের তেহরানে। এই মাসওমেহ এবতেকার ইরানে প্রথম নারী ও পরিবারবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান ৯ আগস্ট ২০১৭। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ও সাংবাদিক। পরিবেশ, সমাজসংস্কারক ইত্যাদি হিসেবেও তাকে চেনে বিশ্বের মানুষ। এসব কাজ করে তিনি প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন। এবতেকার বলেন, ‘আমার এ-সংক্রান্ত কাজ চলবে। এতে আমি প্রচুর মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। আর এ কারণেই এই পথ আমার জন্য সহজ হয়েছে।’
মাসওমেহ এবতেকার দেশটির পরিবেশ বিভাগের প্রধান হিসেবে ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ইরানে কেবিনেটে প্রথম নারী সদস্য হিসেবে কাজ করে ইতিহাসে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত একই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে যেসব শিক্ষার্থী মার্কিন দূতাবাস দখলে নেয় তাদের মুখপাত্র। আর এ কারণেই তিনি ‘ম্যারি’ পদক পান। পরে ইরানের পরিবেশ বাঁচাও সংস্থার প্রধান নির্বাচিত হন। তিনি আরো ছিলেন রাজধানী তেহরানের সিটি কাউন্সিল ওমেন। এ পদে তিনি সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। অথচ তার জন্ম এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। যার নামের প্রথম অংশের অর্থ হচ্ছে (ইংরেজি ভাষার অনুবাদে) ‘নিষ্পাপ জলপদ্ম’। তার পিতা পেনসিলভেনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তিনি পিতার সাথেই সেখানে থাকতেন আপার ডারবি নামক স্থানে। মাত্র ছয় বছর বয়সে এবতেকার প্রায় সঠিক ইংরেজি ভাষা উচ্চারণ শিখে সবাইকে অবাক করে দেন। দেশে ফিরে তিনি ইরান জমিল নামক ইংরেজি স্কুলে নাম লেখান। বড় হয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর আল শরিয়তি নামক ইসলামি রাজনীতিতে সমর্থন দেন। তার রাজনৈতিক দলের নাম ইসলামিক ইরান পার্টি সিপেশন ফ্রন্ট। প্রথাগত কালো চাদর দিয়ে মুখমণ্ডল ব্যতীত সারা শরীর ঢেকে রাখেন।
এবতেকার শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাবরেটরি সায়েন্সে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে তারবিয়াত মডার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমিউনোলজিতে এমএসসি ও পিএইচডি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন। তাররিয়াত মডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকালটি মেম্বার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি তেহরানের একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট একাডেমিক সেন্টার। ইমিউনোলজি বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পিএইচডি এবং এমএসসি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, তদারকি ও উপদেশ দেন। বর্তমানে তিনি সাইটোকাইন্ডস ভাইরাল ইমিউনোলজি, এইচআইভি ভ্যাকসিন এবং নার্ভাস সিস্টেমের রোগবিষয়ক শিক্ষা দান করেন। এদের মধ্যে আরেকটি বিষয় হচ্ছে সাইকে নিউরো ইমিউনোলজি। সম্প্রতি তিনি ইমিউনোলজি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিষয়ে তার নামে প্রায় ৪১টি পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষার কথা তিনি প্রকাশ করেন তেহরানে ইমিউনোলজি বিষয়ক ১১তম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে বক্তৃতা দেয়ার সময়। ইরানে বিজ্ঞানের উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দের ভালো-মন্দ নানা দিক তুলে ধরে বলেন,্ এই বরাদ্দ যেন জাতির ভালো কাজে আসে। তিনি অসংখ্য গবেষণা বোর্ড কমিটির মেম্বার এবং দুটি আন্তর্জাতিক ও চারটি জাতীয় ইমিউনোলজি পত্রিকার পর্যবেক্ষক।
এবতেকার ১৯৮১ সালে কাইজান ইন্টারন্যাশনাল নামক ইংরেজি পত্রিকার প্রধান বার্তা সম্পাদক হন। ’৮৩ সাল পর্যন্ত ওই পদে কাজ করেন। ১৯৯১তে ‘উইমেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৮২ সাল থেকে ‘ফারজানা জার্নাল ফর উইমেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’ নামক পত্রিকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। ’৯৫ সালে চীনের বেইজিংয়ে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের প্রধান হন। উইমেন্স এনজিও কো-অর্ডিনেটিং অফিসের প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। পরে ইরানের ‘নেটওয়ার্ক অব উইমেন্স’ এনজিওর সভাপতি হন।
ইংরেজিতে অগাধ জ্ঞান থাকার কারণে আমেরিকার টেলিভিশনে তিনি মুখপাত্র ও অনুবাদক হিসেবে বহুবার আবির্ভূত হন। তার সুন্দর কাজ দেখে বিদেশী সংবাদ সংস্থা কর্তৃক তাকে ‘টাইগার লিলি’ উপাধি দেয়া হয়। মার্কিন দূতাবাস অবরোধের ওপর ‘১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস অবরোধ কাহিনী’ শীর্ষক একটি বিবরণ লেখেন। ’৯০ সালে নারীবিষয়ক ব্যুরোর প্রধান ছিলেন।
এবতেকার প্রথম ইরানের মহিলা উপরাষ্ট্রপতি পদ অলঙ্কৃত করেন যখন সংস্কারবাদীরা ক্ষমতায় আসে। নারীদের কেবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করার বিপ্লবের শুরু থেকে তিনিই প্রথম কেবিনেটে অংশগ্রহণ করেন। যিনি পরিবেশ বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রায় আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। যেখানে গঠনগত, সংগঠনগত এবং নির্দেশগত দিকনির্দেশনা দেন। এই সময়কালে পরিবেশ সচেতনতা এবং সুশীল সমাজের তৎপরতা তীব্র গতি লাভ করে।
১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পরিবেশবিষয়ক উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক আফগান নারীদের ওপর বর্বর আচরণের তীব্র নিন্দা জানান। মার্চ ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক হেলসিংকিতে একটি অধিবেশন চলাকালে তিনি মূল বক্তব্য পাঠ করেন। সেপ্টেম্বর ২০০২ দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ নামক একটি সম্মেলনে অংশ নেন। মে ২০০৫ এ আন্তর্জাতিক পরিবেশ অধিবেশন, শান্ত ও দ্বিপক্ষীয় মতামত বিষয়ে তেহরানে সভাপতিত্ব করেন। এই অনুষ্ঠানটি এবতেকারের পরিবেশ অধিদফতর এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের পরিবেশ বিভাগ একত্রে মিলে আয়োজন করে।
পরিবেশ রক্ষায় উদ্দীপনা জোগানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করার কারণে ‘ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রমেন্ট প্রোগ্রাম’ তাকে ২০০৬ সালে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি বলেন, এই পদকটি তার পরিবেশ অধিদফতরের পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল। ২০০৮ সালের ৫ জানুয়ারি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় তাকে মুসলিম নারীর তালিকায় একমাত্র ইরানি প্রগতিশীল নারী হিসেবে প্রকাশ করে। ২০১২তে ‘দ্য মুসলিম ৫০০’ পুস্তকে সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই পত্রিকার রাজনীতি বিভাগে তাকে ইরানের সংস্কারবাদী আন্দোলনের শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৪ জানুয়ারি, ২০১৪তে ইরানে ‘এনার্জি গ্লোব ফাউন্ডেশন অনারারি লাইফ টাইম এচিভমেন্ট’ পদক প্রদান করা হয়। বিজ্ঞানে বিশাল অর্জন ও রাজনীতিতে সফলতার জন্য নভেম্বর ২৯, ২০১৪ তাকে ‘ইটালিয়ান মিনারভা’ পদক দেয়া হয়। মিনারভা পদক হচ্ছে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি বেসরকারি পদক, যা ইটালিয়ান সাংবাদিক ও সমাজসংস্কারক ম্যাডাম আন্না মেরিয়া মেমেলিটির মৃত্যুর পর প্রবর্তন করা হয়। এই পদকটি যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখেন তাদেরই দেয়া হয় এবং পুরস্কারপ্রাপ্তরা প্রধানত নারী। ২০১৬ সালে কোরিয়ার সিউলে জানকুক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়া হয়। এবতেকার যে ‘সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ নামক এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন তার উদ্দেশ্য ছিল স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পরিবেশ সংরক্ষণ করা। বর্তমানে প্রায় ১২০ জন শিক্ষাবিদ ও গুণীজন এর সদস্য। ২০০৮ এ নরওয়ের অসলোতে নারী সমতা ও শান্তি নামক অধিবেশনে তিনি মধ্যস্থতা করেন। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পান। এতেই বোঝা যায় তিনি কত বেশি দায়িত্বশীল নারী। মে ৩, ২০০৯ তে ইরানের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি তার সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশ করেন। প্রকাশনাটির নাম ‘দ্য গ্রেপস অব সাহরিভার’। ‘প্রাকৃতিক শান্তি’ নামক আরেকটি রচনা তিনি প্রকাশ করেন। প্রকাশনার মূল বিষয় ছিল পরিবেশ ও স্থায়ী উন্নয়নের জন্য তিনি কী করেছেন। তিনি তেহরান সিটি কাউন্সিল পরিবেশ কমিটি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। যা বর্তমানে পরিবেশ-সংক্রান্ত ২০টি প্রতিষ্ঠান দেখভাল করে। তার লেখা গ্রন্থে তিনি নারী পরিবেশের ওপর গবেষণা-সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি মনে করেন, নারী, পরিবেশ ও অর্থনীতিসংক্রান্ত দিকগুলো শক্তিশালী থাকলে শান্তি, সমৃদ্ধি ইত্যাদি এমনিতেই এসে যায়।

কৃতজ্ঞতায়: নয়াদিগন্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here