ডা. আলমগীর মতি : কোরবানির ঈদে আনন্দ ও উৎসবের মধ্যে অনেকের অতিভোজন হয়ে যায়। মিষ্টি-মণ্ডা ও চর্বি থেকে এসবের বাহুল্য ঘটে দিন-রাতের খাওয়ায়। এতে শরীরের ওজন বাড়ে। সামনে ঈদ, মাংস কম-বেশি খাওয়া তো হবেই। তবে উৎসবে রয়েসয়ে খেলে বাঁচে শরীর।
ঈদে গরু, খাসি ও অন্যান্য পশুর মাংস খাওয়া হয়ে থাকে। সমস্যা হল তাদের, যাদের পেটের সমস্যা, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদেরাগ আছে কিংবা যারা এসব রোগের প্রাক-পর্যায়ে রয়েছে।
তবে পরিমিতি বোধ যেখানে রসনা সংবরণ করতে পারে, সেখানে আর ভয়ের কিছু নেই। মাংসে তেল বা ঘিয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, ভুনা গোশতের বদলে শুকনো কাবাব করে খেলে, কোমলপানীয় ও মিষ্টি একেবারে কমিয়ে খেলে ভালোই থাকা যায়। সেইসঙ্গে হালকা ব্যায়াম বা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি কমিয়ে নিতে পারলে আরও ভালো। এছাড়া তরকারির ঝোল থেকে গোশত কিংবা সবজি আলাদা করে নিয়ে তা ডালে মেখে খেলেও চর্বির পরিমাণ কিছুটা কমে।’
করোনারি হৃদরোগ, বিশেষ করে প্রবীণ ব্যক্তি, যাদের ইসকেমিক হৃদরোগ আছে এবং রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, তাদের তৈলাক্ত মাংস কমিয়ে খেতে হবে। সারা বছর তারা যে ধরনের নিয়মকানুন পালন করা হয় খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে, কোরবানির সময়ও এর ব্যতিক্রম করা ঠিক হবে না। কোরবানির মাংস দু-এক দিন খেলে যে শরীরের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তা নয়। তবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে যারা রয়েছে, বিশেষ করে করোনারি হৃদরোগী, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) রোগী, ডিসপেপসিয়ায় আক্রান্ত রোগী, তাদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ঈদের সময় খাওয়া-দাওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে। স্থূলকায় শরীর যাদের, তাদের অবশ্যই ঈদের সময় খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত ওজন পরীক্ষা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, শরীরের উচ্চতা অনুপাতে স্বাভাবিক ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা।
কোরবানির মাংস সংরক্ষণ করা একটি জরুরি বিষয়। ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব না হলে সঠিকভাবে মাংস জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে। অর্ধসেদ্ধ মাংস কোনোভাবেই খাওয়া ঠিক নয়। মাংসে জীবাণুর সংক্রমণ হলে মারাত্মক অ্যান্টারাইটিস হতে পারে। এটা পেটের এক ধরনের সংক্রামক রোগ, যা খুব ভয়াবহ। যে কোনো পশুর চর্বি খাওয়া এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা রান্না সুস্বাদু হবে এমন ভুল ধারণা পোষণ করে মাংসে বেশকিছু চর্বি আলাদাভাবে যোগ করে থাকি। এটা ঠিক নয়। যতটুকু সম্ভব মাংসের চর্বি ছাড়িয়ে খাওয়া ভালো। বাজারে এখন সবজি এসে গেছে। মাংসের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সবজি খাওয়া যেতে পারে। টাটকা সবজি পাকস্থলীকে সাবলীল রাখে। সেইসঙ্গে দরকার পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা।
উৎসবের দিনগুলোতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ব্যায়াম কিন্তু চালিয়ে যেতেই হবে। এতে বাড়তি ক্যালোরি কিছু হলেও ঝরে পড়ার সুযোগ পাবে।
ভোজে যাওয়ার আগে ফলাহার করে, এক মুঠ বাদাম খেয়ে বেরোলে তেমন অতিভোজন করতেই পারবেন না ভোজের টেবিলে। ব্যায়ামের কর্মসূচিতে বিরতি টানা একেবারেই অনুচিত হবে। নিয়মিত ব্যায়াম, এমনকি ভ্রমণের সময়ও শরীরচর্চা চলবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে। ভোজের সময় হাতের কাছে পানির বোতল থাকতেই হবে।
শরবত, কোমলপানীয়, ড্রিংকস বর্জন করলে ভালো। এতে শরীরে অনাবশ্যক ক্যালোরি যোগ হবে।
মিষ্টি আর চকলেটের প্যাকেট প্রিয়জনকে উপহার না দিয়ে ফল ও বাদামের প্যাকেট উপহার দিলে বেশ স্বাস্থ্যকর হয়। এমন চর্চা শুরু করতে পারেন না কেউ?
স্বাস্থ্যকর আহারের চর্চা উৎসাহিত করা উচিত এবং কেবল রোগীকে দেখার সময় ফল হাতে গিয়ে না; উৎসবে, অনুষ্ঠানে গেলেও তো হয়, না? একটি কাজ করলে কেমন হয়? নিজের বাড়িতে ভোজের আয়োজন করে নিমন্ত্রণ করুন বন্ধু-স্বজনদের। তাদের ক্যালোরিসমৃদ্ধ খাবার পরিবেশন না করে স্বাস্থ্যকর খাবার দিলে খুবই ভালো হবে। অন্যদের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে, ক্যালোরিঘন নয় এমন সব খাবারের নতুন নতুন রেসিপি বানানোর চেষ্টাও করতে হবে।
আইসক্রিম, কোমলপানীয়, চর্বি এড়ানো ভালো। বিরিয়ানি, রেজালা খেলেও কম খেতে হবে। একদিন বেশি খাওয়া হলে পরপর তিন দিন স্লিম আহার করার সংকল্প নিতে হবে। অনেকে ভোজের সময় বেশি খাওয়ার জন্য আগের বেলা না খেয়ে থাকেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়। কোনো বেলার খাবার বাদ দিলে হিতের চেয়ে বিপরীত হবে। এতে ভোজের সময় প্রচুর খাওয়া হবে। খেতে হবে সচেতনভাবে, কেবল ক্ষুধা পেলেই খেতে হয়। মন খারাপ হলে বেশি খাওয়া হয়। প্লেটে থাকুক সবজি-সালাদ, ফলের টুকরা ও দই। এভাবেই উৎসব জমবে, স্বাস্থ্যও থাকবে ভালো।
লেখক : হারবাল গবেষক ও চিকিৎসক, মডার্ন হারবাল গ্রুপ