একাত্তরে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন অনেক নারী। তাদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি, লেখক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কিশোরী, গৃহিণী, শিশু তাদের সংখ্যাও কম নয়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের শহীদ নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন-
সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ছিলেন ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘শিলালিপি’র সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি ‘ললনা’ পত্রিকায়ও কর্মরত ছিলেন। কবি, সাহিত্যিক হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। এ সময় তার ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘শিলালিপি’ স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। এই পত্রিকাটি ছিল বাঙালি সংস্কৃতির বাহক। এর প্রচ্ছদ করেন শিল্পী হাশেম খান। প্রথিতযশা লেখকদের মধ্যে ছিলেন শহীদ জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী। আলবদররা তাদের নিশংসভাবে হত্যা করে।
লেখক আয়শা মোমেন, রাজিয়া খান, আশরাফ সিদ্দিকী, শিল্পী কামরুল হাসান প্রমুখরাও এই পত্রিকায় লিখতেন। শুধু তাই নয়, সেলিনা পারভীন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ ও খাবার দিয়ে সহায়তা করেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছেন এই সংবাদ আলবদর বাহিনীর জানতে সময় লাগেনি। এ সময়ে তৎকালীন সরকার প্রায় সব পত্রিকাই বন্ধ করে দেয়। এই কারণে তৎকালীন সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এ প্রসঙ্গে তার ছেলে সুমন জাহিদ বলেন, আমার বয়স তখন আট বছর। আমরা থাকতাম ১১৫ নং নিউ সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে (বর্তমান ২৯, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক)। বাসায় মানুষ বলতে মোটে তিনজন। আম্মা, উজির মামা আর আমি। একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর, হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা তিনজন ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখি আমাদের বাসার উল্টো দিকে অভিনেতা খান আতার বাসার সামনে একটি ফিয়াট মাইক্রোবাস ও মিলিটারি লরি থেমেছে। কিছুক্ষণ পর আম্মা আমাকে গোসল করানোর জন্য নিচে নিয়ে আসেন। গোসলের পর আমি আবার ছাদে চলে যাই। আবার গাড়ির শব্দ শুনতে পাই। এবার গাড়ি বহরটি আমাদের বাসার সামনে এসে থামে। ছাদে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখি কয়েকজন লোক আমাদের বাসার সামনে এসেছে। তাদের সবারই পরনে একই রঙের পোশাক আর মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। ওরা আমাদের বাসার মেইন লোহার কলাপসিবল গেটে ধাক্কা দিচ্ছিল। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের একজন ভদ্রলোক কলাপসিবল গেট খুলে দেন।
ওরা ভদ্রলোকের কাছে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের পরিচয় জানতে চায়। ভদ্রলোক আমাদের ফ্ল্যাটটি দেখিয়ে দেন। ভদ্রলোককে তার ঘরে যেতে বলে ওরা আমাদের ফ্ল্যাটে এসে দরজায় কড়া নাড়ে। আম্মা দরজা খুলে দেন। ওরা আম্মার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। বাসায় কে কে থাকে তাও জেনে নেয়। আম্মার সঙ্গে ওদের বেশকিছু কথা হয়। ততক্ষণে উজির মামা আর আমি সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা উঁকি দিলে ওরা আমাদের দেখে ফেলে। আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। আমরা ভয় পাই। আমি আম্মার কাছে চলে আসি। ওরা আম্মাকে ওদের সঙ্গে যেতে বলে। আম্মা ওদের বলেন, ‘বাইরে তো কার্ফ্যু। এখন যাব কিভাবে?’ ওরা আম্মাকে বলে, ‘ওদের সঙ্গে গাড়ি আছে। তাছাড়া তাদের সঙ্গে কার্ফ্যুর পাস আছে। কোনো সমস্যা হবে না’।
ওরা নাছোড়বান্দা, আম্মাকে নিয়ে যাবেই। ওদের জোরাজুরিতে আম্মা তখন বলেন, ‘ঠিক আছে। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি শাড়ি বদল করে আসি।’ ওরা বাধা দেয় আম্মাকে। বলে, ‘দরকার নেই। গাড়িতে করে যাবেন আবার গাড়িতে করেই ফিরে আসবেন’। আমিও তখন আম্মার সঙ্গে যেতে চাই। কিন্তু ওরা আমাকে ধমক দিয়ে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বলে, ‘বাচ্চা লোক নেহি জায়েংগা’। আমি আম্মার হাত ধরে থাকি। আম্মা আমার মাথা ও গালে হাত বুলান। এরপর আমাকে বলেন, ‘সুমন তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসব’। এটাই ছিল আমার জীবনে আম্মার কাছ থেকে শোনা শেষ কথা। ওরা মামা আর আমাকে ঘরের ভেতর চলে যেতে বলে। আমি দরজার ফাঁক দিয়ে আম্মাকে দেখতে থাকি। আম্মা হাত মোছার জন্য রান্নার সময় কোমড়ে একটি গামছা ঝুলিয়ে রাখতেন। ওরা আম্মার কোমড়ের সেই গামছাটি টেনে নিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। হাত পিছমোড়া করে বাঁধে। ওরা আম্মাকে নিয়ে চলে যায়। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ ডিসেম্বর চলে যায়।
আম্মা আর ফিরে আসেন না। অন্যদের কাছে শুনেছি ১৮ ডিসেম্বর আম্মার লাশ পাওয়া গেছে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। এরপর শুনেছি এবং তদন্তের মাধ্যমে উঠে এসেছে ওরা ছিল আলবদর বাহিনী। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ইনচার্জ চৌধুরী মঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে আলবদররা আম্মাকে বাসা থেকে অপহরণ করে। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো আলবদর বাহিনী রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আম্মাকে হত্যা করে। আম্মার পরনে সাদা শাড়ি-ব্লাউজ, সাদা স্কার্ফ, পায়ে সাদা জুতা মোজা দেখে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার আত্মীয়রা শবদেহ সহজেই শনাক্ত করেছিলেন।
কবি মেহেরুন্নেসা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। কিন্তু তিনি তার মা ও বড় বোনের কাছে লেখাপড়া শিখে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। লিখেন একের পর এক জ্বালাময়ী কবিতা। এটা অবাঙালিরা সুনজরে দেখেনি। একাত্তরের মার্চে অবাঙালিদের রোশানলে পড়েন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। কবি মেহেরুন্নেসার ডাক নাম রানু। থাকতেন অবাঙালি অধ্যুষিত ঢাকার মিরপুর এলাকায়। পরিবারের সদস্য বলতে বাবা-মা আর ছোট দুই ভাই। পাকিস্তানি শোষকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মিরপুরে বাঙালিরা হরতাল ডাকে। অবাঙালিরা তাতে বাধা দেয়। বাঙালিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক প্রতিনিধি যোগ দেন। কবি মেহেরুন্নেসা ছিলেন এই কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য। অবাঙালিদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কবি মেহেরুন্নেসা জ্বালাময়ী কবিতা লিখেন। কবিতার শিরোনাম ছিল ‘জনতা জেগেছে।’ এই কবিতাটি ছিল তার লেখা শেষ কবিতা। এটি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তিনি বাংলার মানুষকে এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন- ‘মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা/ দুরন্ত দুর্বার/ সাত কোটি বীর জনতা জেগেছে/ এ জয় বাংলার’… ।
কবি মেহেরুন্নেসার বন্ধু ছিলেন কবি কাজী রোজী। শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা সম্পর্কে কবি কাজী রোজী বলেন, কবি মেহেরুন্নেসার জ্বালাময়ী কবিতা স্বাধীনতার পক্ষের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। তেমনি একাত্তরের ২৩ মার্চ মিরপুরে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। কবি মেহেরুন্নেসা তার বাড়িতেও স্বাধীন পতাকা উড়িয়েছিলেন। এই পতাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে অবাঙালিদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিবাদে জড়িয়ে পড়েন বাঙালিরা। কবি মেহেরুন্নেসা ও তার পরিবার অবাঙালিদের টার্গেটে পরিণত হয়। ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে কয়েকজন অবাঙালি ঢাকার মিরপুরে তার ডি ব্লকের ৬ নম্বর বাড়িতে ঢুকে। ওদের মাথায় সাদা ও লাল পট্টি বাঁধা, হাতে রামদা, তলোয়ার এবং চাকু-ছুরি। ওরা যখন কবি মেহেরুন্নেসার দুই ভাইকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, কবি বলেছিলেন, ‘ওরাতো কিছু করেনি, যা করেছি আমি করেছি, তোমরা আমাকে মারো।’ হত্যাকারীরা কবির কোনো কথা শোনেনি। জবাই করে ওর দুই ভাইকে। এই দৃশ্য দেখে কবির মা বুকে কোরআন শরিফ চেপে ওদের বলেছিলেন, ‘আমরাতো কলেমা জানি, আমরাতো মুসলমান।’ কবির দুই ভাইয়ের পড়ে থাকা লাশের দিকে তাকিয়ে তার মা অজ্ঞান হয়ে যান। অবাঙালিরা কবি মেহেরুন্নেসা ও তার মায়ের শির-েদ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল ৭টার দিকে পাকসেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা শিববাড়ি মন্দিরে ঢোকার প্রথম চারতলা ভবনের দোতালায় উঠে দরজায় আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। দোতলায় থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর রেস্তোরাঁর মালিক মধুসূদন দে ওরফে মধু দা। পাকসেনাদের দরজার আঘাতহানায় মধু দা দরজা খুলে দেন। সাত থেকে আট জন পাকসেনা ঘরে ঢুকে সব জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলে। এ প্রসঙ্গে মধুসূদন দে’র মেজ ছেলে প্রত্যক্ষদর্শী অরুণ কুমার দে বলেন, প্রথমে পাকসেনারা আমার বড়দা রণজিৎ কুমার দে’র বুকে গুলি করে। সেখানেই তিনি শহীদ হন। এরপর তারা আমার বৌদি রণজিৎ কুমার দে’র নববিবাহিতা স্ত্রী রিনা রানী দে’কে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পাকসেনারা বাবা মধুসূদন দে’কে গুলি করতে উদ্যত হলে আমার মা যোগমায়া দে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গুলি করে মা’র দুটি হাত বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেখানেই আমার মা শহীদ হন। এরপর ওরা বাবার ডান পা ও ডান হাতে গুলি করে।
৩৫ নম্বর শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা প্রকাশ সুর জানান, ২৫ মার্চ ভোর রাতে পাকসেনারা ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে আক্রমণ চালায়। তাদের বাড়িটির অবস্থান জজকোর্টের মুখে। পাকসেনাদের গুলির শব্দে ভয়ে রাত পার করেন। সকাল হতেই ২৬ মার্চ সপরিবারে শাঁখারীবাজারের মাঝামাঝি একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন নিরাপত্তার কথা ভেবে। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রাণভয়ে ঠাকুরমাকে নিয়ে বাবা পাগল নাথ সুর, মা ভাগ্যবতী সুর ও চার ভাই বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেই ২৯ মার্চ সকালে। কেরানিগঞ্জ যাওয়ার পথে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করলাম। বুড়িগঙ্গা নদীতে লাশের পর লাশ ভাসছে। আনুমানিক বেলা বারোটার দিকে কেরানিগঞ্জ পৌঁছাই। ঢাকার শাঁখারীবাজারের মতো অনেক এলাকা থেকে নারী-পুরুষ-শিশু কেরানিগঞ্জ এলাকায় আশ্রয় নেন। ২ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৪টার দিকে পাকসেনারা কেরানিগঞ্জে আক্রমণ করে। এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। আমার বাঁ পায়ে গুলি লাগে। আমার মা ভাগ্যবতী ছয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন। বেলা ১টার দিকে তার পেটে গুলি লাগলে সেখানেই তিনি শহীদ হন। পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণে শাঁখারীবাজারের অনেক নারী শহীদ হন। তাদের মধ্যে ৫১ নম্বর শাঁখারীবাজারের যামিনী ঘোষাল (৬৫), সুনীতা সুর (৮), বুদ্ধদেব সুর (আড়াইবছর), ৬০ নম্বর শাঁখারীবাজারের পারুল বালা সুর, ১২৪ নম্বর শাঁখারীবাজারের কুসুম বালা সেন, চম্পা রানী সেন, চম্পা রানী সেনের পাঁচ মাসের শিশু সন্তান, গীতা রানী সেন (৬), ১৯ নম্বর শাঁখারীবাজারের কৃষ্ণ দাসী সেন (২৮), ৪০ নম্বর শাঁখারীবাজারের কদম কুমারী নন্দী (৩৮), রেবা রানী নন্দী (১২) ও প্রতিভা রানী নন্দী (৮) শহীদ হন।
নারায়ণগঞ্জের মাসদাইরে একাত্তরের ২৭ মার্চ বেলা ১২টার দিকে পাকহানাদার বাহিনী জামিল ডক ইয়ার্ডের মালিক জসিমুল হকের বাড়িতে ঢুকে। এ প্রসঙ্গে শহীদ লায়লা হাসান বানু ডলির মেয়ে শেলী নিলুফার জানান, পাকসেনাদের ভয়ে তাদের আশপাশের ছয়টি পরিবারের সদস্য তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। দু’জন পাকসেনা অফিসারসহ ১০/১২ জন জোয়ান পুরুষদের নারী ও শিশু থেকে আলাদা করে রাস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে তার আব্বাও ছিলেন। পাকসেনারা পুরুষদের গুলি করে হত্যা করে। একজন জোয়ান তার মা লায়লা হাসান বানু ডলিকে সঙ্গে করে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। আলমারি খুলিয়ে স্বর্ণালংকার লুট করে। এরপর তার মায়ের বুকে বেয়নেট চার্জ করে। এতেও ক্ষান্ত হয় না হানাদারেরা। গুলি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তিনি ঘরে গিয়ে দেখেন মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ডাক্তার ডেকে এনে চিকিৎসা করেও মাকে বাঁচাতে পারেননি। বাবা-মা দু’জনেই শহীদ হন।
মাসদাইরে এই গণহত্যার পর পাকসেনারা নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা অফিসে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকসেনাদের ভয়ে পৌরসভার বিপরীতে আমেনা মঞ্জিলের মালিক আমেনা বেগম ছাদ থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামাচ্ছিলেন। পাকসেনারা এই দৃশ্য দেখামাত্র তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। সেখানেই তিনি শহীদ হন। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া ইউনিয়নের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আবদুর রহিম, মুড়াপাড়া জুট মিলের মালিক গুল বখস ভূঁইয়া, লতিফ, লাল মিয়ার সহায়তায় পাকসেনারা ডেমরা থেকে গানবোটে চড়ে মুড়াপাড়া বাজারে আসে ১২ এপ্রিল। সকাল ১০টার দিকে পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে মুড়াপাড়া হিন্দুপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। মুড়াপাড়া পাইলট স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক পণ্ডিত রাধা বল্লভ দাস পাকসেনাদের গ্রামে আসার সংবাদ শোনামাত্র তার স্ত্রী অমত্য দাসী ও তিন বছরের নাতনী মহামায়াকে নিয়ে মেয়ের গ্রামের বাড়ি জাঙ্গীরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শহীদ পণ্ডিত রাধাবল্লভ দাসের বড় মেয়ে অঞ্জলি দাসের মতে, মুড়াপাড়া ইউনিয়ন অফিসের সামনে পৌঁছতেই বাবা-মা আর আমার মেয়ে পাকসেনাদের সামনে পড়ে যান। পাকসেনারা আমার মেয়ে মহামায়াকে জিজ্ঞেস করে, তুমি হিন্দু না মুসলমান? মহামায়া হিন্দু বললে একজন পাকসেনা তাকে কাঁধে তুলে নেয়। বাবা পণ্ডিত রাধা বল্লভ দাসকে পাকসেনারা পিছমোড়া করে সুপারিগাছে বেঁধে উলঙ্গ করে তার ওপর নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের পর গুলির প্রস্তুতি নেয়। আমার মা অমত্য দাসী বাধা দিতে গেলে দু’জনকেই গুলি করে লাশ খাদে ফেলে দেয়। মহামায়াকে কাঁধে নিয়ে গ্রামের প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ করে। নিরপরাধ হিন্দু লোকগুলোকে ধরে এনে মায়া সিনেমা হলের সামনে জড়ো করে। এই হত্যাযজ্ঞ থেকে সেদিন একজন হিন্দু শিশুও রক্ষা পায়নি। ৫/৬ জন মানুষকে একই রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে হত্যা করা হয়। এরপর লাশগুলো মুড়াপাড়া নগরের প্রফুল্ল মাস্টারের বাড়ির বাঁশঝাড়ের সামনে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখে। পাকসেনারা গ্রামে তাণ্ডবলীলা শেষ করতে করতে বিকাল হয়ে যায়। তারা মহামায়াকে বিকালে বিস্কুট কিনে খাওয়ায়। মেয়েটিকে সারা দিনই পাকসেনারা কাঁধে রেখেছিল। এরপর ওর দাদু রাধাবল্লভের লাশের সামনে এসে পাকসেনারা মহামায়াকে কাঁধ থেকে নামায়। পাকসেনারা ওকে হাঁ করিয়ে মুখের ভেতর গুলি করে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মুড়াপাড়া নগরে পাকসেনারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেদিন ফিরে গেলেও কয়েকদিন পর তারা বিকাল ৪টার দিকে মুড়াপাড়া বাজারের কাছে শীল বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে আসে। ঋষিপাড়ার কয়েকজন বৃদ্ধা বার্ধক্যের কারণে পালিয়ে যেতে পারেননি, তারা ঘরেই ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সূর্যমনি দাসী (৬০), অমত্য রানী (৬২), সরলা দাসী (৬২), সুমিত্রা দাসী (৭০)। ১৫ থেকে ২০ জন পাকসেনা তাদের টেনেহিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে এনে দড়ি দিয়ে বেঁধে পুকুরপাড়ে গাবগাছ এবং বাঁশঝোপের তলায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এ ছাড়া কুলসুম বিবি, কৃষ্ণ দাসী, খুশি রানী, সূচারু রানীও পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। রূপগঞ্জের ভুলতা ইউনিয়নে বলাইখাঁ গ্রামে পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দিনের বেলায় গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশ করে। গ্রামে ঢুকেই তারা কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন বলেন, পাকসেনারা একেকটি বাড়িতে ঢুকে ঘর থেকে নারী-পুরুষদের টেনে বের করে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা বলাইখাঁ গ্রামের শাহাজউদ্দীনের স্ত্রী মরিয়ম, কেরামত আলীর মেয়ে লতিফা দেওয়ানিকে হত্যা করে। এপ্রিল মাসের এক রাতে পাকসেনার একটি দল বন্দরের মদনগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির কাছে চিত্তবাবুর বাড়িতে আক্রমণ করে। পাকসেনারা তার স্ত্রী, মেয়েকে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। ১০ মে রাত সাড়ে ১০টার দিকে পাকসেনারা পুনরায় স্থানীয় রাজাকারদের সংবাদের ভিত্তিতে বন্দরের মদনগঞ্জ পোস্ট অফিস এলাকায় আসে। বন্দরের মদনগঞ্জের পুলিশ ফাঁড়ির কাছে নিখিল সরকারের (সত্য সরকার নামেও পরিচিত) বাড়িতে ঢুকে। নিখিল সরকারের বাড়িতে ঢাকার শাঁখারীবাজার থেকে আগত দুই বোন জয়া রানী সরকার ও ভেলা রানী সরকার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা দু’বোনই নিখিল সরকারের আত্মীয়া। পাকসেনারা দু’বোন জয়া রানী সরকার ও ভেলা রানী সরকারকে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে।
রীতা ভৌমিক ছবি : মুনির আহমেদ