জোবাইদা নাসরীন: গত ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন সেখানকার ছাত্র আবরার ফাহাদ। তার মাত্র আড়াই মাস যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে দুজনকে ডাকসু ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয় বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই হামলার শিকার তুহিন ফারাবিকে রাখা হয়েছিল আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে র্যাগিংসহ সন্ত্রাসের বিপক্ষে হাঁকডাক শুরু করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এগুলো যে শুধুই আওয়াজই ছিল, তা বোঝা গেছে এই আক্রমণ থেকেই। নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁকে নির্বাচিত করেছেন, নেতা বানিয়েছেন। একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর কীভাবে দাঙ্গাবাজি কায়দায় প্রকাশ্যে হামলা করা যায়? এবারই শুধু নয়, বারবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বাইরেও আক্রমণের শিকার হয়েছেন এই ভিপি। তিনি সর্ববৃহৎ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্রসংসদের সহসভাপতির (তা যে দল বা মতেরই তিনি অনুসারী হন বা না হন) ওপর এভাবে বারবার প্রাণঘাতী হামলা হচ্ছে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ কিংবা সরকার কেউ তাঁকে ক্যাম্পাসে কিংবা ক্যাম্পাসের বাইরে ন্যূনতম নিরাপত্তাও দিতে পারছে না? প্রশাসন এবং ছাত্রলীগ থেকে বলা হয়েছে, সেখানে ডাকসু ভবনে নুরুর সঙ্গে বহিরাগতরা ছিল। নুরু তা স্বীকার করেই বলছেন, তিনি অনিরাপত্তাজনিত কারণে একা চলাফেরা করেন না। যদি প্রশাসন বহিরাগত বিষয়টিকেই জোর দেয় তাহলে প্রশ্ন, নুরুর নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল? ক্যাম্পাসে কী কখনো বহিরাগত আসে না? শুধুই আসা-যাওয়া নয়, ছাত্রহলগুলোতে বহিরাগতরা তো সব সময়ই থাকছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ‘অতিথি’ হিসেবে। সেগুলো প্রশাসন জেনেও না জানার ভান করে। কারণ হয়তো এই অতিথিদের নিয়ে কথা তারা বলতে চায় না, শুধু নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব পালন করে।
বহিরাগত থাকলেই হামলা করা বৈধ? ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া বৈধ? লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যাওয়ার মতো মারধরকে কীভাবে বহিরাগত তত্ত্ব দিয়ে ঢাকা যাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত প্রবেশ নিষেধ? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইনিয়ে-বিনিয়ে কেন বহিরাগত বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছে? মানলাম আপনাদের যুক্তি যে এই বহিরাগতদের ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি সেটি মোকাবিলা করত, প্রয়োজন হলে সেই উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা বহিরাগতদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিত। এগুলো দেখার দায়িত্ব তো প্রশাসনের, বিশেষ করে প্রক্টর অফিসের, ছাত্রলীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নয়।
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ব্যানারে ছাত্রলীগের এই হামলা আসলে কী ইঙ্গিত করে? ভবিষ্যতে কোথাও আর কোনো ধরনের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত হবে না? নির্বাচন হলে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সংগঠন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না? কিংবা করলেও ছাত্রলীগকেই সব পদে জয়ী ঘোষণা করতে হবে? ছাত্রলীগ বাদে অন্য সংগঠনের কেউ জয়ী হলে তাঁকেও নুরুর মতো অবস্থায় পড়তে হবে? নাকি তাঁকেও ছাত্রলীগে যোগ দিতে হবে? তাঁকে ‘পাগলা’ অথবা ‘শিবির’ খেতাব দেওয়া হবে? তাকে ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে? তাঁকে বারবার মার খেয়ে টিকে থেকে নিজের তেজস্বী জেদের পরিচয় জারি রাখতে হবে? তাঁকে ক্যাম্পাসে এ রকম মার খেতে হবে?
বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অহংকার মুক্তিযুদ্ধ। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামীয় সংগঠনটিকে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে করে সন্ত্রাস করার অধিকার কে দিয়েছে? এরা কারা? কেন তারা এই ব্যানারে আক্রমণ করল? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহিরাগতদের উদ্দেশ্য নিয়ে বিচলিত ছিল, কিন্তু এই মঞ্চের উদ্দেশ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল না কেন? কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করেছে এই কারণে? নাকি এখন এই শব্দ ব্যবহার করে কারও ওপর নিপীড়ন কিংবা হামলা করলে সেটি বৈধ হয়ে যাবে এই ভরসায়?
ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের মতাদর্শ, রাজনীতি কিংবা তাঁর রাজনৈতিক ঘরানা নিয়েও ভিন্নমত বা বিরোধিতা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত। তাঁকেই ছাত্রছাত্রীরা দেখতে চেয়েছেন ডাকসুর নেতা হিসেবে। তাঁকে দফায় দফায় মার দিয়ে কী সফলতা অর্জন করতে চায় ছাত্রলীগ? তিনি ছাত্রলীগ করবেন? ডাকসু থেকে পদত্যাগ করবেন? নাকি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির পরাজয়ের প্রতিশোধ? নাকি ডাকসুতে ছাত্রলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নতম পোষণ করেন বলেই নুরকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগের এই ‘নুরু শিক্ষা’ কর্মসূচি? বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতি। তিনি এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
ভিন্নমতকে গ্রহণ করাই হলো গণতন্ত্র। আর সেটি ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই ভিন্নমতকে জায়গা না দিতে পারার মনস্কতার ক্যাম্পাসগুলোতে বারবার সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ড এবং মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে। মূল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রতি আহ্বান করছি, নিজেরা ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করুন এবং ছাত্রসংগঠনগুলোকে ভিন্নমতের প্রতি সম্মান করার জন্য নির্দেশ দিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও সংগঠননিরপেক্ষ হওয়া জরুরি। তাতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে আর প্রশ্ন করার অবকাশ থাকবে না।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
কৃতজ্ঞতায় প্রথম আলো।