কাইয়্যুম আব্দুল্লাহ: জিহাদ। এসময়ের সবচেয়ে অজনপ্রিয় ও ভীতিকর একটি শব্দ। অথচ এই নিকট অতীতেও মানুষ জজবা ও নিজের সৎসাহসের প্রকাশ ঘটাতে নামের সাথে অবলীলায় জিহাদী বা জঙ্গী জুড়ে দিতো। আদতে যদিও তাদের তেমন জোশ-জজবা কিছুই ছিলো না। বিশেষ করে কিছু মৌলভী সাহেব- যেমন অমুক জিহাদী তমুক জঙ্গী। তথাকথিত টেরোরিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে পরিবর্তিত এই সময়ে এখন আর কেউ এসব ব্যবহারের সাহস করবেন বলে মনে হয় না। কারো নামের সাথে থেকে থাকলেও ইতোমধ্যে হয়তো তা বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে বা তাদের সে নামে সম্বোধন না করলেই বেশী খুশি হবেন। অথচ টেরোরিজমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদের ঘোষণাই হতো যৌক্তিক ও সঠিক। এই শব্দের অর্থ এটাই দাবী করে। যেমন আমাদের সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি (স্বৈরাচার হলেও) হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। রাজনীতিকরা না খোশ হলেও সেই জিহাদে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিলো। হালজামানায় একশ্রেণীর মিডিয়া সেই সুন্দর অর্থবোধক শব্দটিকে ইচ্ছেমতো রঙ লাগিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি। উজ্জ্বল কোনো রঙ হলেও কথা ছিলো। কিন্তু না, এমন কালো ও কুৎসিত আবরণে তা ঢেকে দেয়া হয়েছে যা শুনলেই মানুষ ভড়কে যেতে বাধ্য।
তবু সুখের কথা যে, চরম দু:সময়েও সমাজে কিছু সত্যিকারের সৎসাহসী মানুষ ও মণীষা থাকেন- যারা শত বাধা-বৈরীতাকে উপেক্ষা করে তাদের কাজে সত্যের উদ্ভাস ঘটাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী তাদেরই একজন। সম্প্রতি যার দুটো বই বেরিয়েছে। ইংরেজি ভাষায় লিখা বই দুটির একটি হলো- ‘অ্যা লং জিহাদ: মাই কুয়েস্ট ফর দ্যা মিডল ওয়ে’ এবং আরেকটি হলো- ‘দ্যা রোহিঙ্গা ক্রাইসিস: অ্যা পিপল ফেইসিং এক্সটিংশন’। বই দুটি গত সামারে বেরুলেও বাংলা মিডিয়ার সাথে এর পরিচয় ঘটলো গতকাল (০২/০৪/১৯) মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। ওয়াইটচ্যাপেলের ফিস্ট রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত প্রেস লঞ্চে উপস্থিত লেখক-সাংবাদিকগণ বই দুটি বিশেষ করে অ্যা লং মাই জিহাদ বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখকের সাহসিকতার এবং সময়োপযুগিতা পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন।
বই দুটি অনেকেরই এখনো পড়ার সুযোগ হয়নি তথাপি প্রকাশনা উৎসবের জন্য লিখিত লেখক-সাংবাদিক আকবর হোসেনের প্রবন্ধে বই দুটির সার-সংক্ষেপ ও লেখক সম্পর্কিত আলোকপাত সবাইকে একটি স্বচ্ছ ধারণা দানে সক্ষম হয়েছে।
জিহাদ সম্পর্কে অন্যান্যদের মতো মুসলমানদের মধ্যেও অনেকের ভ্রান্ত ধারনা বা অস্বচ্ছতা রয়েছে। তা না হলে এমন ভীতি ও অপপ্রচারের বিস্তার সম্ভব হতো না। অনেকের ধারনা- জিহাদ মানেই যুদ্ধ! তরবারী দিয়ে ইসলাম অমান্যকারী বা বিরুদ্ধাচারনকারীকে কতল করা। তাই প্রবন্ধের লেখক যথার্থই উল্লেখ করেছেন –
“বর্তমানের বৈরী সময়ে জিহাদের মতো পবিত্র শব্দক যারা হাইজ্যাক করে সমাজে নেতিবাচক ধারণা তৈরীর অপচেষ্টায় লিপ্ত এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে ড. বারী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তার আত্মজীবনীমূলক বইটি লিখে একটি বিরাট জিহাদ করেছেন।”
সত্যি জিহাদের আসল অর্থ ও উদ্দেশ হাইজ্যাক হয়ে গেছে। বিশেষ করে ইসলামের পোশাকী (যদিও ইসলামে নির্দিষ্ট কোনো পোশাক নেই বা পোশাকী মূল্য নেই) পরিচয়ধারী ভ্রান্ত আইএস নিজেদের জিহাদী এবং নির্বিশেষে মানুষ হত্যাকে জিহাদ আখ্যা দিয়ে একধরনের রোমাঞ্চ পেতে এবং কিছু তরণযুবাকে বিভ্রান্ত করতে সফল হয়েছে। আর একে পূঁজি করে একশ্রেণীর মিডিয়া বিকৃত প্রচারণা ভালো ও সুন্দর অর্থবোধক এই শব্দটিকে বলা যায় পঁচিয়ে দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, এই মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশে দেশে জেকে বসা স্বৈরাচারী সরকারগুলো ধর্মীয় ভাবধারার বিরোধীদের দমিয়ে রাখতে তাদের বিরুদ্ধে এসব শব্দর অপপ্রয়োগকে মূল অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে।
যতটুকু জেনেছি, জিহাদ মাত্রই যুদ্ধ কিংবা ধর্মযুদ্ধ নয়। এর শাব্দিক অর্থ চেষ্টা বা প্রাণান্ত চেষ্টা। বলা যেতে পারে প্রয়োজনে যুদ্ধ জিহাদের অংশ মাত্র। নিজের জীবন থেকে শুরু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের আমূল পরিবর্তনের চেষ্টাই জিহাদ।
বৈরী সমাজ। এমনকি আমেরিকাবাসী আত্মজ মেয়েরও অনুরোধ বাবা এ শব্দটি (জিহাদ) কি বাদ দেয়া যায় না? ড. বাবীর আত্মজীবনমূলক এই বইটিতে সেটি না রাখলেও পারতেন। কিন্তু না, তিনি কিছুতেই আত্মপ্রবঞ্চক হতে গেলেন না। বরং নিজের দীর্ঘ পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষাজীবনের অর্জন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উগ্রডান কিংবা চরমপন্থার বামে না গিয়ে ইসলাম নির্দিশিত মধ্যপন্থায় সাবিত কদম বা স্থির থাকতে পারার যে কঠিন জিহাদ করে গেছেন, সেটিকে তিনি সামাজিক ভ্রুকুটির কাছে বিসর্জন দিতে যাননি। শেষ পর্যন্ত নিজের পছন্দের উপরই অটল থেকেছেন।আমি বলবো- এর মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লেখক তথা মণীষা ব্যক্তিত্বে উপনিত হয়েছেন।