মো: আবদুস সালিম: নিকোলা শ্যারন মেন্ডেলসোহন একজন নামকরা ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন নির্বাহী। তার আরেক নাম লেডি মেন্ডেলসোহন। তিনি বিজ্ঞাপনশিল্পে সক্রিয় ১৯৯২ সাল থেকে। নিকোলা ফেসবুকের জন্য ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সহরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ২০১৩ সালের জুনে। ডিয়াজিওর একজন অভিজ্ঞ নির্বাহী পরিচালকও ছিলেন তিনি। এর সদর দফতর ইংল্যান্ডের লন্ডনে। দফতর রয়েছে বিশ্বের প্রায় ছয়টি দেশে। তার দাফতরিক নানা কাজের সফলতা দেখে তাকে ‘ব্রিটিশ প্রযুক্তিশিল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী নারীকর্মী’ হিসেবে অভিহিত করেছে ডেইলি টেলিগ্রাফ।
তার আরেকটি নাম আছে। সেটি হলো নিকোলা শ্যারন কিনি। তার জন্ম ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। বিএ ইংরেজি এবং থিয়েটার স্টাডিজ নিয়ে লেখাপড়া করেন লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটি ইংল্যান্ডের পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের লিডস নামক স্থানের একটি পাবলিক রিসার্চ ইউনিভার্সিটি। এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৭৪ সালে। শিক্ষা লাভ করেন ম্যানচেস্টার হাইস্কুল ফর গার্লস নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। এটি একটি ইনডিপেনডেন্ট ডে স্কুল। এর লক্ষ্য হচ্ছে ‘আজকের শিক্ষার্থী, আগামীর কৃতী নারী’। ৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা এখানে ভর্তি হতে পারে। এটি অবস্থিত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে ফেলোফিল্ড নামক স্থানে।
নিকোলা শ্যারনের মা সেলিয়া কিনি একজন সফল কোসের ক্যাটারার। কোসের ক্যাটারার মানে হচ্ছে খাদ্যপুষ্টি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি। এ সংক্রান্ত আইনও ভালো জানতে হয়। তার বাবা বেরি কিনি সেলিয়া কিনি ব্যানকুয়েটিংয়ের চেয়ারম্যান। এটিও ক্যাটারিং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি তার ভাই মার্কও কাজ করেন পারিবারিক ব্যবসায়। আর প্রায় ১৭ বছর ধরে পড়াশোনা করেন নিকোলা শ্যারন।
একটা সময়ে নাটক স্কুলে পড়াশোনার চিন্তাভাবনা হয় নিকোলা শ্যারনের। ইচ্ছে ছিল অভিনেত্রী হওয়ার। কিন্তু তার এক বন্ধুর পরামর্শে নিকোলা অভিনয় জগতে না ঢুকে বরং বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত কাজের দিকে মনোনিবেশ করেন। তাকে একটি স্নাতক প্রশিক্ষণ প্রকল্পের দেখভালের প্রস্তাব দেয়া হয় বার্টেল বোগল হাগার্তিতে (বিবিএইচ)। বিবিএইচ হচ্ছে ব্রিটিশ গ্লোবাল বিজ্ঞাপনী সংস্থা। এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৮২ সালে। এর দফতর রয়েছে লন্ডন, নিউইয়র্ক সিটি, সিঙ্গাপুর, সাংহাই, মুম্বাই, স্টকহোম এবং লস এঞ্জেলেসে। সেখানে তিনি কাজ করেন সেপ্টেম্বর ১৯৯২ থেকে জানুয়ারি ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এর মূল লক্ষ্য বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডাইরেক্টর বা বিডেডাকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি গ্রে লন্ডনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হন ২০০৪ সালের এপ্রিলে। গ্রে লন্ডন হচ্ছে গ্রে গ্লোবাল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এটি হচ্ছে বিজ্ঞাপনী এবং বিপণন এজেন্সি। এর সদর দফতর নিউইয়র্ক সিটিতে। প্রায় ৯৬টি দেশে এর দফতর রয়েছে প্রায় ৪৩২টি। তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। তিনি গ্রে কমিউনিকেশন গ্রুপের ইউরোপীয় ব্যবসায় বিকাশের পরিচালকও ছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। ২০০৮ সালের এপ্রিলের দিকে লন্ডনের বিজ্ঞাপন সংস্থা কারমারামার অংশীদার ছিলেন। পাশাপাশি এর নির্বাহী চেয়ারম্যান হন। কারমারামা লন্ডনভিত্তিক একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা, যা প্রতিষ্ঠা লাভ করে ২০০০ সালের দিকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পেশাগত জীবনে নিকোলা শ্যারন বিজ্ঞাপন সংগ্রহ এবং রাজনৈতিক পরিচিতির ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে এগিয়ে যান।
নিকোলা শ্যারন কাজের সমতা বা ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স নিয়ে শক্ত মতামত দেন। ব্যক্তি জীবন, পেশাগত জীবন এবং পারিবারিক জীবনে কাজের ধারার ক্ষেত্রে সমতা মানে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স। নারীদের ক্ষেত্রেও নমনীয়তা প্রদর্শন করা হয় কাজেকর্মে। তারা দিনে কাজ করবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। তিনি বিবিএইচ’র সময়কালে তার প্রথম সন্তানের বয়স এক বছর হওয়ার পর থেকে তিনি সপ্তাহে কাজ করেন চার দিন। তিনি সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কাজ করেন ফেসবুকেও। তিনিও এ নিয়মে চলেন, যাতে অন্যরা তা মেনে চলে, তাকে দেখে। অর্থাৎ কাজের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসুক।
ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ কাউন্সিলের সহসভাপতির দায়িত্ব সফলভাবে পালন করছেন মেন্ডেলসোহন। পাশাপাশি নারী কথাসাহিত্যের জন্য বেলির পুরস্কারের পরিচালক। বেলিস প্রাইজ ফর উইমেন্স ফিকশনকে আগে বলা হতো অরেঞ্জ প্রাইজ ফর ফিকশন, অরেঞ্জ ব্রডব্যান্ড প্রাইজ ফর ফিকশন ইত্যাদি। এটা ইউনাইটেড কিংডমের খুবই সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার। নারী সাহিত্যিকদের এ পুরস্কার দেয়া হয় বার্ষিকভাবে। ২০১৫ সালে তাকে ২০১৫ সালের রানীর জন্মদিন সম্মানের অংশ হিসেবে সৃজনশীল শিল্পগুলোতে পরিষেবা দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্ডার অফ সিটিবি বা সিবিই নির্বাচিত করা হয়। কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ অ্যাম্পায়ার (সিবিই) মানে হচ্ছে যারা সর্বসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নতির নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৭ সালের ৬ জুন। পাশাপাশি আইটি ফিল্ডে ৫০ জন প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পান ৩৪ নম্বরে। তিনি জিকিউ’র (ব্রিটেনের) ১০০ সর্বাধিক সংযুক্ত নারী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন ২০১৪ সালে। তাকে উইমেন টু ওয়াচও বলা হয়ে থাকে নারীদের ভাগ্যের উন্নতির জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়ায়।
নিকোলা শ্যারন জোনাথন মেন্ডেলসোহনকে বিয়ে করেন ১৯৯৪ সালে। তার স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ লবিস্ট এবং লেবার রাজনৈতিক সংগঠক। একপর্যায়ে নিকোলা জানতে পারেন তার শরীরে শনাক্ত হয়েছে রক্তের একটি অসাধ্য ক্যান্সার। যার নাম ফলিকুলার লিস্ফোমা। তিনি বলেন, এটি বিরল না হলেও অল্প পরিচিত হিসেবে এর বর্ণনা করা যায়। এ প্রসঙ্গে নিকোলা শ্যারন বলেন, কোনো খারাপ সংবাদে ভেঙে পড়লে চলবে না। অর্থাৎ মনের দিক থেকে তিনিও ভেঙে পড়েননি বলা যায়। তিনি বলেন, ক্যান্সার সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা বাড়াতে এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে নিকোলার সাজেশন হলো, যদি আপনি ভয় না পান, তবে আপনার যা করার ইচ্ছা তাই করুন। তিনি বলেন, আমার রক্তে যখন দুরারোগ্য ক্যান্সারের জার্ম ধরা পড়ে তখন আমি প্রায় ৪৫ বছরের নারী। চার সন্তানের এ জননী বলেন, আমি কি আমার সন্তানদের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বেড়ে উঠতে দেখতে পারব? তবে রোগ ধরা পড়ার আগে আমি মোটেই অসুস্থ অনুভব করিনি এবং আমি সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলাম। যখন আমাকে স্ক্যানের জন্য পাঠানো হয়, সত্যিকারের আতঙ্ক প্রকাশ পায় তখনই। আমি দেখতে পাই, টিউমার রয়েছে আমার সারা শরীরে। কুঁচকে একটি ছোট পিণ্ডও ধরা পড়ে, যা একটি মটর আকার ছিল। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য ধরনের ক্যান্সার সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি, কিন্তু ফলিকুলার লিস্ফোমা সম্পর্কে আমরা কমই জানি। এমন রোগে আক্রান্তরা সর্বোচ্চ প্রায় ২০ বছর বাঁচতে পারে। এমনকি এমন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এক বছরের মধ্যে মারা যাওয়ার খবর শোনা গেছে। তিনি বলেন, এ রোগে আক্রান্তদের বেশির ভাগেরই চুল হারাতে হয়, যা আমার ক্ষেত্রে হয়নি। ফলিকুলার লিম্ফোমাকে অদৃশ্য ক্যান্সার হিসেবেও মনে করা হয় ক্ষেত্র বিশেষে। এটি ধীরলয়ে ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার। তিনি বলেন, যা মানুষকে অবাক করেছে তা হলো, আমি সব কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছি। আমি ভাগ্যবান যে, এ ক্ষেত্রে আমি সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি আমার সহকর্মীসহ পরিবারের।
সারাবিশ্বে এ ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষদের জন্য একটি সুন্দর ফেসবুক গ্রুপের অংশও তিনি। এর নাম ‘লিভিং উইথ ফলিকুলার লিম্ফোমা’। বর্তমানে এ গোষ্ঠীর সহপ্রশাসক তিনি। এর প্রচুর শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে। সমর্থন ও পরামর্শের একটি অবিশ্বাস্য উৎস এটি। তিনি বলেন, লন্ডনে অনেক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আছেন। এ ধরনের বিশেষজ্ঞ সর্বত্র থাকা জরুরি। আমরা এ সংক্রান্ত যা শিখি তা অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নিলে ভালো হয়। তার পরও বলতে হয়, বিশ্ব চিকিৎসাশিল্প অনেক বেশি এগিয়ে গেছে, যদিও অনেক স্থানে প্রতারক চক্রও রয়েছে।
ক্রনিক ফলিকুলার লিম্ফোমা কী? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এটি এক প্রকার নন-হজক্কিন লিম্ফোমা বা এনএইচএল। এটি তখনই বিকশিত হয় যখন শরীরে অতি মাত্রায় বি-কোষ তৈরি করে। শ্বেত রক্তকণিকা যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে বি-কোষগুলো। এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে তৈরি হতে পারে। এর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো বগল, ঘাড় ইত্যাদি জায়গায় ব্যথাহীন ফোলাভাব দেখা দেয়া। এটি নিরাময়ে মাঝে মধ্যে কেমোথেরাপি দিতে হয় রোগীকে।এ রোগকে নিকোলা শ্যারন ‘একটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ হিসেবে মনে করেন। তাকে কখনওই অসুস্থ বোধ করাতে পারেনি ক্যান্সার। চিকিৎসার দিনগুলোতেও তিনি পরের দিনের কাজ নিয়ে ভাবেন। নিকোলা বলেন, অসুস্থ ছুটির প্রস্তাব দিয়েছিল আমার সংস্থা। আমি তা না নেয়াকেই ভালো মনে করতাম। তার এখন প্রতি আট সপ্তাহে নিতে হয় ‘টপ আপ’ ইমিউনোথেরাপি। তিনি মনে করেন, তার অসুস্থতা যেকোনো সময় রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, স্তন ক্যান্সারের জন্যও আমরা একইভাবে নারীদের দেহ পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করি। নিউইয়র্কের একটি রাতের খাবারের অনুষ্ঠানে নিকোলা বেশ কয়েকজন লিস্ফোমা বিশেষজ্ঞদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
নিকোলা শ্যারন বলেন, একজন ইতিবাচক এবং আশাবাদী মানুষ আমি। এটিই আমার একমাত্র উপায় বা অবলম্বন। দুর্দান্ত মানসিক শক্তি জোগায় এটি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমরা এ ক্ষেত্রে এমন একজনের অংশীদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি, যিনি রীতিমতো অদৃশ্য অসুস্থতার স্পটলাইট। নিকোলা শ্যারন বলেছেন, অনেক সময় আমরা নিজেরাই নিজেদের অজান্তে অনেক ক্ষতি করে থাকি। অনেক সময় সমস্যার প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার কারণেও সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খাই।
সাহসী নিকোলা শ্যারন বলেন, যতক্ষণ না কাউকে মৃত্যুর মুখে পড়তে না হয় ততক্ষণ তিনি সুরক্ষিত। তিনি ফলিকুলার লিস্ফোমা ফাউন্ডেশন (এফএলএফ) চালু করেন, যাতে এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষদের সুস্থ হতে এবং ভালোভাবে বাঁচতে সাহায্য সহযোগতিা করে। এর লক্ষ্য হলো এ সংক্রান্ত নতুন কার্যকরি চিকিৎসা, রোগীদের অর্থ সংস্থান, তাদের পরিবারগুলোকে নানাভাবে সহায়তা করা, গবেষণার অর্থ সংগ্রহ করা ইত্যাদি। অর্থাৎ দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যা করা দরকার তা করার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর।
নিকোলা মনে করেন, এটি করার সময় আমার (নিকোলার) জীবদ্দশায়ই। ফাউন্ডেশনের আকেরটি লক্ষ্য হলো, বিশ্বজুড়ে যেসব মানুষ যে গ্রন্থিক লিম্ফোমা নিয়ে কষ্টে আছে তাদের খুঁজে বের করা। আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেয়ার জন্য প্রচুর তহবিল জোগাড় করতে হবে। তিনি বলেন, এ অর্থবহ প্রচারের ক্ষেত্রে সৃজনশীল বিকাশের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য ব্যাপক সম্মানিত হয়েছি আমি। আমার কাজ নাকি শৈলীপূর্ণ। দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি প্রথম তিন বছরে ২০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্য নেয়।