রুমান হাফিজ: পৃথিবীর ইতিহাসে ‘পতাকা হাতে বিশ্বভ্রমণকারী নারী হিসেবে বাংলাদেশী নাজমুনই প্রথম! পৃথিবীর পথে পথে লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে যার হাত ধরে, তিনি নাজমুন নাহার! তিনি নারী ও তরুণ সাফল্যের এক উজ্বল স্বাক্ষর! তিনি বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী নারী হিসেবে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন! পৃথিবীব্যাপী নারীদের যোগ্যতা প্রমাণের বাধাগুলো নাজমুনের মতো নারীদের দেখেই ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে।
হৃদয়ে যার বাংলাদেশ আর দুই চোখে বিশ্ব
হৃদয়ে যার বাংলাদেশ তাকে আমি শুধু নারী জাগরণের অনুপ্রেরণা বলব না, তিনি আমাদের দেশাত্মবোধের জাগরণের অগ্রজ! যে দেশে তার জন্ম সেই দেশকে নিয়ে তার এমন এগিয়ে যাওয়ার ভাবনা সত্যি আমাদের শিরকে উন্নত করে! ১৬ কোটি মানুষের মনে তোলে এক শিহরণজাগানো চেতনা!
বিদেশের মাটিতে যখনই নাজমুন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেন, তখন আমাদের মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, আনন্দের অশ্রুধারা বইতে থাকে! মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া পতাকার সম্মানকে তিনি সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে ধরছেন একে একে! এ যাবৎ তিনি ১১০টি দেশে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যাওয়ার মতো একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছেন!
নাজমুন বলেন, ‘যে দেশের মানুষ তার কাজের মাঝে, আবিষ্কারের মাঝে দেশের কথা ভেবে কাজ করবে, সে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে; তাই আমাদের সবাইকে দেশের কথা ভেবেই নিজের কাজের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আমি বিশ্ব দেখছি বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে, এটি আমার দেশাত্মবোধ থেকে করছি, কারণ পতাকা ভাবনা আমার কাছে দেশপ্রেমের একটি চিহ্ন!’
এগিয়ে যাওয়ার একাকী সাধনা
ছোটবেলা থেকে তার পারিবারিক কোনো বাধা না থাকলেও, সামাজিক বহু প্রতিবন্ধকতা তাকে পার হতে হয়ে হয়েছে!
নাজমুন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বাবা আমাকে লড়াকু হতে শিখিয়েছেন, তাই আমি বিস্তৃত ভাবনা নিয়ে বড় হয়েছি, বড় করে নিজেকে ভাবতে শিখেছি, বড় বড় স্বপ্ন দেখতে শিখেছি, স্বপ্নকে বাস্তব করার জন্য যত কষ্ট, যত বাধা এসেছে সব কিছুকে অতিক্রম করেছি! সমাজের ভ্রƒকুটিকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে গেছি! অনেক মৃত্যুকে জয় করে পর্বত চূড়ায় আরোহণ করেছি! একা একাই পৃথিবীর মানচিত্রের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করেছি!’
‘আমি একাই সব কাজ করতে পছন্দ করি, একা পথ চলতে গিয়ে পড়ে গেলে আবার একাই উঠে দাঁড়াই। তাতে আমার সাহস ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়! তাই আমি একাই নির্ভয়ে বিশ্বের পথে পথে হাঁটছি!’
বিশ্বজোড়া শান্তি মিশন
বিশ্বজুড়ে তার দীপ্ত পদচারণার শব্দে উদ্দীপিত অনেক তরুণ! পৃথিবীজুড়ে তিনি শিশু ও তরুণদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন শান্তির বার্তা, আর তাদের জাগিয়ে তুলছেন স্বপ্ন দেখার শিহরণে! সম্প্রতি তিনি ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিশ্ব শান্তির বার্তা পৌঁছান! তিনি উগান্ডা, রুয়ান্ডা, ইথিওপিয়া, লেসোথো, সোয়াজিল্যান্ড, কলম্বিয়া, ডোমিনিকান রিপাবলিক, বেলিজ ও কিউবাসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার’ স্লোগানে বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন!
নাজমুন বলেন, ‘আমারা সবাই একই পৃথিবীর মানুষ একই সূত্রে গাঁথা! একই শেকড় থেকে আমাদের জন্ম! একই সূর্যের আলো পাই, একই আকাশের নিচে বসবাস করি! আমরা একই পৃথিবীর মানুষ, একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত! তাই আমামদের ধর্ম, বর্ণ, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সব কিছু ভুলে গিয়ে পৃথিবীতে শান্তি বিরাজের কথা ভাবতে হবে!’
এসব বার্তা পৌঁছে দিতেই নাজমুন নেমে পড়েছেন পৃথিবীর পথে পথে! তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ, আর্মি ক্যাম্প, আদিবাসীসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষে জীবনযাপনের কথা তুলে ধরে বিশ্ব মানবতাবোধকে জাগিয়ে তুলছেন! বাংলাদেশের পতাকা হাতে তিনি বিশ্ব শান্তির এক অনন্য দূত হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছেন সারা বিশ্বে!
বিশ্ব ভ্রমণের রেকর্ড
২০০০ সালে ইন্ডিয়ার পাচামরিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে’ অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার প্রথম বিশ্ব ভ্রমণ শুরু! সেখানেই তিনি প্রথম বিশ্বের ৮০টি দেশ থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধমে বিশ্ব শান্তি ও একাত্মতার কথা তুলে ধরেন! তার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি চলছেন পৃথিবীর এক এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে!
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ৯৩তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেছেন নিউজিল্যান্ড!
এই দুর্দান্ত সাহসী নারী ২০১৮ সালের ১ জুন ১০০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে! তিনি বাংলাদেশের পতাকা হাতে জাম্বিয়ার সীমান্তবর্তী লিভিংস্টোন শহরে অবস্থিত পৃথিবীর বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে জিম্বাবুয়েতে পৌঁছান! ইতিহাসে তার শততম দেশ ভ্রমণের সাক্ষী হয়ে রইল এই ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত! যে জলপ্রপাতটির অর্ধেক বহমান জাম্বিয়ায়, বাকি অর্ধেক বহমান রয়েছে জিম্বাবুয়েতে! এখন পর্যন্ত তিনি তার ভ্রমণের ১১০টি দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন! তিনি ইরানে অবস্থান করছেন! সেন্ট্রাল এশিয়া ভ্রমণ শেষ করেই তিনি নামিবিয়া হয়ে আফ্রিকার বাকি দেশগুলোতে তার যাত্রা অব্যাহত রাখবেন বলেও জানান।