লন্ডন, ২০ ডিসেম্বর: যাদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও একটি গর্বিত জাতিসত্ত্বার বির্নিমাণ সম্ভব হয়েছে জাতির সেইসব সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করলো বৃটেনের বাংলা মিডিয়া। বরাবরের মতো গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে এবারও ব্যতিক্রমী আয়োজনে বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস উদযাপন করলো বিলেতের বাংলা মিডিয়ার প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল প্লাটফরম লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব। ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারানো শহীদ স্বজনদের করুণ কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের গর্বিত সন্তান।
‘শহীদ পিতার গল্প” শীর্ষক বিশেষ আয়োজনে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের দুই সদস্য যথাক্রমে সাংবাদিক বাবুল হোসেন ও সাংবাদিক আকবর হোসেন তাদের বাবা, ভাই, চাচাসহ প্রিয় স্বজনদের হারানোর হৃদয়বিদারক স্মৃতিকথা বর্ণনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো এলাকার খন্ড চিত্র তোলে ধরার চেষ্টা করেন। তাদের অশ্রুসিক্ত ও আবেগঘন স্মৃতিচারণ পুরো অনুষ্ঠানকে এক অন্যরকম ভাবগাম্ভীর্যে আবিষ্ট করে রাখে। একই সাথে ক্লাবের অপর সদস্য সামসুর রহমান সুমেলের বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম বাবার অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে সিলেটের বালাগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত করতে নেতৃত্বদানকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল বিশেষ আলোচকের বক্তব্যে গেরিলাযুদ্ধসহ রণাঙ্গণে শত্রুবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে মুখোমুখী হওয়ার নানা লোমহর্ষক কাহিনীর বর্ণনা দেন। তাদের সবার বক্তব্যে দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় অর্ধশত বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রত্যাশিত অনেককিছুর বাস্তবায়ন না হওয়া বিশেষ করে বহুল আলোচিত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারদের স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত তালিকা প্রস্তুত না করতে পারার ব্যর্থতায় ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে। দীর্ঘ অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশেষ আলোচক, মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল এবং স্মৃতিচারণকারী শহীদ পরিবারের সন্তানদের ফুলেল শুভেচ্ছার মাধ্যমে বরণ করা হয়। তাদের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, সেক্রেটারিসহ বর্তমান কার্যকরী কমিটির সদস্যবৃন্দ। অনুষ্ঠানে বাড়তি বাগাড়ম্বর ও বক্তাদের আধিক্য না থাকায় এই বিশেষ তিনজনের বক্তব্য উপস্থিত সবাই মনযোগ সহকারে শোনেন ও হৃদয়ঙ্গম করেন।
গত ১৭ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের নিজস্ব কার্যালয়ে বিজয় দিবসের এই বিশেষ আয়োজন ক্লাব সভাপতি মুহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ জুবায়েরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক্লাবের সাবেক, বর্তমান নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ সদস্যদের বিপুল উপস্থিতি ঘটে। লন্ডনের বাইরের শহর ওলডহ্যাম, লিডস ও বার্মিহাম থেকেও ক্লাবের সদস্যরা এসে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। নিজ এলাকা হানাদারমুক্ত করায় নেতৃত্ব দিতে পেরে সৌভাগ্যবান: মুক্তিযাদ্ধা আজিজুল কামাল অনুষ্ঠানের বিশেষ আলোচক, বালাগঞ্জ পাক-হানদার মুক্ত করায় নেতৃত্বদানকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল তাঁর বক্তব্যের শুরুতে উপস্থিত সবাইকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, দেশের একজন সন্তান হিসেবে সেই গুরু-দায়িত্ববোধ থেকে যুদ্ধে জড়াই। যুদ্ধদিনের কঠিন চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, যদি আর ফিরে না আসি তা ভেবে যখন কোনো অপারেশনে যেতাম তখন পুরোপুরি বিদায় নিয়েই যেতাম। এসময় তাঁর কণ্ঠ অনেকটা জড়িয়ে আসে। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেরিলা আক্রমণের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, একদিন পাকবাহিনীর অ্যাম্বুসে পড়ে গিয়ে তারা তাদের হাতে ধরা খেয়ে যান। এসময় সাথী মুক্তিযোদ্ধা মছব্বিরকে পাকবাহিনী বেদড়ক পেটায় তবে আল্লাহর দয়ায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান তারা। তাদেরকে একটি ঘরে আটকে রেখে হানাদার বাহিনী চলে যাওয়ার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সেখান থেকে দরজা ভেঙে কোনো রকমে আমরা বেরুতে সক্ষম হই এবং স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা আমাদের আশ্রয় দেন।
বালাগঞ্জ হানাদার মুক্ত করার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে অপারেশন করে আমাদের এলাকাকে মুক্ত করবো। কিন্তু বিভিন্ন কারনে তখন তা ব্যর্থ হয়। তবে পরবর্তীতে ভালোভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে ইলাশপুরে পাক-বাহিনীকে অ্যাম্বুস করে হটিয়ে দিতে সক্ষম হই। তা করার পরই বালাগঞ্জ থানার ওসিকে ডেকে এনে বলি, এক্ষুনি আত্মসমর্পন করতে হবে নইলে থানা উড়িয়ে দেবো। অর্ডার শোনার সাথে সাথে ওসি সবাইকে নিয়ে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। তাদের আত্মসমর্পনের খবর শোনার এলাকার উৎফুল্ল মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের একনজর দেখতে সেখানে ছুটে আসেন। আমরা থানার সম্মুখে উড়তে থাকা পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।
নিজেকে একজন সৌভাগ্যবান মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে আজিজুল কামাল বলেন, অনেক সুপরিচিত ও বয়সে বড় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেদিন বালাগঞ্জ হানাদার মুক্ত করার নেতৃত্ব দেওয়ার গুরু-দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান বলেন, যে আশা নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম তার অনেককিছু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারনে পূরণ হয়নি। তবুও যতুটুকু হয়েছে তাতে আমি সন্তুষ্ট আমার তেমন কোনো আফসোস নেই। এক্ষেত্রে তিনি সাংবাদিক সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়ে বলেন, সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পুরনে সবার এগিয়ে আসা দরকার।
বাবার আদর বঞ্চিত হলেও একটি স্বাধীন দেশ ও মানচিত্র পাওয়ার আনন্দই এখন মনের বড় শান্তনা: আকবর হোসেন
প্রথমে শহীদ পরিবারের সন্তান আকবর হোসেন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শাহাদত বরণকারী তাঁর পিতার করুণ কাহিনী বর্ণনা করেন। পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে উপস্থাপন করা বর্ণনা শুধু তাঁর শহীদ পিতার স্মৃতিচারণেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, এসময় তিনি পুরো এলাকারই একটি সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রচিত অমর গীতিকাব্য ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলবো না …” দিয়ে শুরু করেন তিনি। তারপর একে একে তুলে ধরেন পতাদের এলাকা জগন্নাথপুরের রাণীগঞ্জের পুরো চিত্র। তারিখভিত্তিক পাক-হানাদার বাহিনীর নৃসংশতার চিত্র তুলে ধরে তিনি জানান, বাবা আকলু মিয়ার সাথে তাদের ছোট চাচা ও এক খালুও শহীদ হন। একই দিন তাদের এলাকার বিনোদ রায়সহ আরো অনেকে হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মা ফিরোজা বেগমের কাছে লেখা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক চিঠি তুলে ধরে তিনি বলেন, আমার বয়স তখন চার বছর ছিলো তাই সেইদিনের স্মৃতি খুববেশী মনে নেই। মায়ের কাছ থেকে শোনা বাবা আকলু মিয়া শহীদ হওয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বাবা নাকি দেখতে আমার মতোই ছিলেন। আমার বাবা তখন বাজার কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রতিদিনের মতো গ্রামের বাড়ি থেকে তিনি রাণীগঞ্জ বাজারে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তিনি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। একইদিন তার আরেক চাচা ও খালুও শহীদ হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করে আকবর হোসেন জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের পরিবার দুই হাজার টাকা করে রাষ্ট্রীয় ভাতা পেতো। ছোটবেলা বাবার আদর বঞ্চিত হলেও একটি স্বাধীন দেশ, মানচিত্র ও পতাকা পাওয়ার আনন্দই এখন মনের বড় শান্তনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তবে একটাই দাবী, যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কিংবা গাজী তাদের সঠিক লিস্ট হউক এবং তাদের রাষ্ট্রীয় স্কীকৃতি দেয়া হউক। রাণীগঞ্জের সেতুটি যেন শহীদ-গাজীর নামে নামকরন করা হয় সেই দাবীও জানান তিনি।
অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি পাননি: বাবুল হোসেন