নওশিন বিনতে কাশেম: সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত বিষয় বিশ্বের বিখ্যাত ধনী দম্পতি বিল গেটস ও মেলিন্ডার বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাটি। টুইটারে তাদের ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা পাওয়ার পর পরই সামাজিক এবং সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। এটা শুধু তাদের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো সেলিব্রেটি বা আশপাশের কারো বিচ্ছেদের গুঞ্জন উঠেলেই নানা মন্তব্য আমরা দেখি। কিন্তু খুব বিস্ময়ের কিংবা হতাশার ব্যাপার হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমাদের দেশের মানুষের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলো আবেগের জায়গাগুলোতে আঘাত করার প্রবণতা।
আমরা খুব সহজেই ভার্চুয়াল ছবি, পোস্ট দেখে মানুষকে বিচার করি, কখনো কারো মনের অবস্থা বা মানসিক যন্ত্রণা না বুঝেই মজা করতে গিয়ে হয়তো অনেক বেশি আঘাত করে ফেলছি। কারো সম্পর্কগুলোর গভীরতা, সমস্যা না বুঝেই একটা মন্তব্য করে ফেলি। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ এই চরম সত্যের সঙ্গে বিয়ের ফুলও সবার জীবনে ফুটবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। হয়তো কেউ ভালোবেসে চেনা মানুষকেই আপন করে আবার কেউ সম্পূর্ণ অচেনা দুজন মানুষ সারাজীবন একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়েই নতুন জীবনের সূচনা করে কিন্তু সংসার বড়
অদ্ভুত জায়গা, বড় কঠিন। সংসারে প্রবেশ করেই ধীরে ধীরে মানুষ সম্পর্কের গভীরতা বুঝে, কারো মানিয়ে নেওয়ার আবার কারো মেনে না নেওয়ার গল্প শুরু হয়।
এই সমাজে মনে করা হয় একবার বিয়ে হয়ে গেল মানে আপনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। সংসারটাকে আমরা যাবজ্জীবন কারাগার বানিয়ে ফেলেছি। আর কারাগার ভাবা হয় বলেই হয়তো আমরা অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগি, ছোট ছোট বিষয়গুলোকে জটিল বানিয়ে ফেলি। অথচ এই ছোট্ট জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত যদি খুব সহজভাবে নিয়ে নেতিবাচক সবকিছু দূরে ছুড়ে ফেলতে পারতাম তাহলে কত সুন্দর মসৃণ পথ হতো আমাদের। যুগ যুগ ধরে কত মানসিক অশান্তি আর লৌকিকতার জন্য বা সমাজ কী বলবে এই ভেবে দুজন মানুষ না চাইলেও হয়তো অনেক প্রাণহীন সম্পর্ক চালিয়ে যায় যেখানে কোনো ভালোবাসার ছোঁয়া নেই, সম্মানের কোনো বালাই নেই। কিন্তু যদি পারস্পরিক সম্মানবোধ নিয়ে একটু ইতিবাচকভাবে দুজন দুজনকে সহযোগিতা করে নিজেদের একটু বোঝার চেষ্টা করি তাহলে কত সুন্দর একটা পবিত্র সম্পর্ক ভালোবাসা দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠত। কিন্তু এই আধুনিক যুগে আমরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়েছি আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে, সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে গেছে, দিন দিন মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ যে কারণে বিচ্ছেদের হার বাড়ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পারস্পরিক সম্মানবোধের অভাব, ভুল বুঝাবুঝি, টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলা, ইগো, পরকীয়া, যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, শারীরিক সম্পর্কের দূরত্ব ইত্যাদি। এছাড়াও খুব ছোট ছোট ঝগড়া থেকেও নিজেদের সম্মান আর মানসিক শান্তির কথা ভেবে মানুষ এখন সমাজের ভয়ে অভিনয় করে সম্মান টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী না। সমাজের কাছে খুব নগণ্য মনে হলেও একজন দম্পতির কতটা মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে একটা সম্পর্ক ভাঙতে পারে তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বুঝে। কিন্তু সমাজের একপক্ষ খুব সহজেই ইস্যু বানিয়ে নেতিবাচক কুত্সা রটাতে একটুও ভাবে না। কারো ভালো না লাগলে নিজেরা নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে চাওয়াটা তো অপরাধ না!
শিক্ষিত নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, তারা নিজেদের ভালো থাকা নিয়ে ভাবছে, লোক দেখানো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা নিয়ে ভাবে না। যে যার মতো ভালো থাকার অধিকার সবার আছে। অবশ্যই যে হাত সারাজীবন একসঙ্গে চলব বলে ধরা হয় সেটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা সবার আন্তরিকভাবে সর্বোপরি চালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু যখন মতামত আর মানসিকতা মিলে না তখন অবশ্যই তাদের মতামতকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত, কটূক্তি না করে। পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল, মানুষও ব্যতিক্রম নয়। মন বদলায়, ভালোবাসার রং বদলায়, নতুন করে নিজেদের মতো করে মানুষের বাঁচার ইচ্ছা জাগে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুত্সা না রটিয়ে সম্মান জানিয়ে আমরা কি তাদের মত করে তাদের বাঁচতে দিতে পারি না?