আঞ্জমান রোজী : গেলো রোববার ও সোমবার; অর্থাৎ ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর – পূর্বলন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে ‘বাংলাদেশ বইমেলা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব-২০১৮’ শীর্ষক বইমেলাটি এ যাবত প্রবাসে অনুষ্ঠিত বইমেলার মধ্যে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
উৎসবমুখর এই মেলায় বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রকাশক অংশগ্রহণ করেন। যা বিদেশবিভূঁইয়ে আয়োজিত বইমেলায় বাড়তি প্রাণের সঞ্চার ঘটায়! পাঠক, লেখক, প্রকাশক এবং সাংবাদিকদের মিলনমেলার প্রাণকেন্দ্র হলো বইমেলা; যা নিজদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ঝাণ্ডা তুলে ধরতে সহায়ক হয়। এমন বইমেলার আয়োজনে প্রাণে পন্দন অনুভূত হয়। কারণ, বইপ্রেমীদের জন্য বইমেলা একটি তীর্থস্থান। তাই, যখনই বইমেলার কথা ওঠে; তখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। কাজের স্বার্থে কিংবা সময়ের অভাবে অনেক বইমেলায়; বিশেষ করে বাংলাদেশের একুশের মেলাতেও সবসময় যোগ দিতে পারিনা। কিন্তু মন ঠিকই ছুটে যায়। যেমনটি ছুটেছিল মন – সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ ইউকে আয়োজিত ৮ম বাংলাদেশ বইমেলা ২০১৮তে।
কবি মিলটন রহমান, কবি আবু মাকসুদ, কবি ইকবাল হোসেইন বুলবুলের অনুরোধে তিনদিনের জন্য সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম। টরন্টো থেকে লণ্ডন পৌঁছানোর পরপরই – বৃষ্টির রমরমা ভাব দেখে মনটা দমে গিয়েছিলো। যে উত্তেজনা আর আনন্দ নিয়ে এসেছিলাম; তা যেন বৃষ্টিস্রোতে ভেসে যায়। আকাশের গুমোটভাব আমার ওপরেও ভর করে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বিষমভারে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছিলাম কাঙিক্ষত দিনটির জন্য। বইমেলার দিন সকাল থেকে বেশ কয়েকজনের ফোন পেয়ে ঝেড়েঝুড়ে উঠে পড়ি! মেলার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। শাড়ি, চুড়ি, গহনার আড়ম্বরপূর্ণ সাজসজ্জায় মেতে উঠলাম। মেলা প্রাঙ্গণে পা রাখতেই; নিজেকে মনে হলো ঝাঁকের পায়রা! উড়ুউড়ু মন! দলবেঁধে ওড়ার সে কী আনন্দ! মেলাপ্রাঙ্গণে প্রথমেই দেখা হয়ে গেলো টরন্টো থেকে আগত আরেক বিশিষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সাথে। তারপর দেখা হলো; একেএকে প্রিয় সব মানুষের সাথে। সেইসাথে ক্যামেরার ক্লিক চলছে তার নিজস্ব নিয়মে। একসময় কবি আবু মাকসুদ কাছে এসে আমাকে উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন। এখানে কবি বা কবিতা নয়; শুধু মননের শুদ্ধদ্বারের উন্মোচন। ভালোলাগা আর ভালোবাসায় উদ্বেলিত পরিবেশ।
ছোট্ট ছিমছাম একটি হলরুমে বসেছিলো বইয়ের রাজত্ব। বাংলাদেশ আর লণ্ডনের প্রকাশকদের সারিসারি স্টল সাজানো হয়েছিল হলের চারদিক জুড়ে! ঐতিহ্য আর শিল্পের নান্দনিকতার ছোঁয়া ছিলো সর্বত্র। চোখজুড়ানো রঙের আবহে পরিবেশটা ছিল শ্রান্ত এবং স্নিগ্ধ। সেইসাথে, সকলের আন্তরিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল প্রাণের মেলা, বইমেলা। পাশেই আরেকটা হলরুমে সাংস্কৃতিক এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে হলভর্তি দর্শকের মুহুর্মুহু করতালিতে পুরো পরিবেশ মুখরিত হয়ে ওঠে। অনুষ্ঠানের শুরুতে শিশুকিশোরদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল হৃদয়গ্রাহী। কারণ, তারাই যে ভবিষ্যতের পুরোধা। এমন ভাবনা থেকেই শিশুকিশোরদের শুরুতেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিলো। আলোচনাপর্বে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মঞ্চে উপবেশন; এবং সেইসাথে তাদের গুরুগম্ভীর, জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মুগ্ধ দর্শকশ্রোতাদের পিনপতন নিরবতা ছিল লক্ষণীয়!
নানারঙের বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন- বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সুসাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ। যদিও আমি সেই মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে পারিনি। একটু বিলম্ব করে সেখানে পৌঁঁছাতে মনের ভেতর অপরাধবোধ কাজ করছিল। তারপরেও মেলার প্রবেশমুখে হাসিমাখা মুখের কিছু প্রিয় মানুষ এসে আমাকে যখন স্বাগত জানালো, তখন বেশ স্বস্তি পাচ্ছিলাম। মেলা ঘুরেঘুরে আমরা গিয়ে বসলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেখানে হচ্ছিলো সেখানে অর্থাৎ থিয়েটার হলে।
অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন স্মৃতি আজাদ ও রেজওয়ান মারুফ। আলোচনা পর্বে কবি আসাদ মান্নানের দরাজকণ্ঠে আবৃত্তিসহ আলোচনাটি ছিল বিশেষ আকর্ষণীয় একটি অংশ।তিনি মেলার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বই আমাদের মনের চাহিদা মেটায়। বইমেলার আয়োজন মনের সেই চাহিদারই জোগান দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ’বই না থাকলে আমিও হয়তো আজকের আসাদ মান্নান হয়ে উঠতে পারতাম না। তিনি আরও বলেন, ’সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় চাই সৃজনশীল মানুষ; যাদের নিজের ভেতরে জ্ঞানচর্চার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি আছে। বই পড়ার মাধ্যমে সেই ইচ্ছাশক্তি শাণিত হয়। শেকড় সংস্কৃতির সঙ্গে প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে সম্পৃক্ত রাখতে – এমন আয়োজন আরও বেশিবেশি হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, যিনি কিংবদন্তি তূল্য প্রবাদপুরুষ; যুক্তরাজ্যের বাঙালি কমিউনিটির মহীরুহ হয়ে আছেন, আছেন উৎসাহ আর প্রেরণার শক্তি হয়ে। তিনি বলেন, লণ্ডনে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে আটবছর ধরে। টানা সাতবছর অনুষ্ঠিত হওয়ার পর; বিশেষ কারণে গতবছর এটি অনুষ্ঠিত হয়নি। এবছর আবার বইমেলা আয়োজন করায় উদ্যোক্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান তিনি। একমাত্র তাঁকেই দেখলাম অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত ধৈর্য সহকারে বসে থাকতে। বড়মাপের মানুষের ধৈর্য্যশক্তি যে পাহাড় সমান হয় তার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখলাম গাফফার চৌধুরীকে দেখে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুক্তরাজ্যের সভাপতি – জনাব ফারুক আহমদ বলেন, ভিনদেশে বসবাস করলেও মাতৃভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি রয়েছে আমাদের জন্মাবেগের সুগভীর টান। সেই টান থেকেই প্রবাসে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখছে আমাদের অনন্য প্রচেষ্টা! ভবিষ্যতে এই
মেলার পরিসর আরও বৃহৎ; আরও উৎসবমুখর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি!
বইমেলা সংক্রান্ত উচ্চাশা আর ভবিষ্যৎবাণী শুনে মেলাশেষে বেরিয়ে আসি। বিদায় পর্বে মন বইমেলাতেই পড়েছিল, যদিও ফিরে যেতে হয়েছিল পারিবারিক কারণে। বইমেলা নিয়ে প্রত্যাশা আমাদের সবসময় বেশিই থাকে। প্রবাস জীবনের বৈরী পরিবেশে নিজদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা করা; এবং সেইসাথে প্রজন্ম থেকে প্রজান্মান্তরে তা ছড়িয়ে দেওয়া সহজ কাজ নয়।
তারপরেও কাজ চলছে। এদিক থেকে যুক্তরাজ্যের বাঙালি কমিউনিটির কর্মকাণ্ড অগ্রগণ্য। তার প্রমাণ আজকের এই বইমেলা। বলা যেতে পারে – এই আয়োজন সকল প্রবাসীর কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাভাষার সমৃদ্ধি এবং প্রচার-প্রসারের কাজ আরও তরান্বিত হবে; সেইসাথে কলেবরে বইমেলার আয়োজন হবে আরও বেশিবেশি; এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি! সেইসাথে আশা রাখছি আগামীতেও ঠিক এভাবে আবার দেখা হবে।