সারওয়ার-ই-আলম: আশির দশকে বাংলাদেশ বেতারে একটি অনুরোধের আসর সম্প্রচারিত হতো, নাম ছিল চাওয়া-পাওয়া। এই আসরে প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠে প্রিয় গান শোনার জন্য অনুরোধ জানিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতাম আমি। সে যে কী দীর্ঘ অপেক্ষা! অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে একদিন অনুষ্ঠান ঘোষকের ভরাট কণ্ঠে ভেসে আসতো, শ্রোতা বন্ধুরা এবার আপনারা শুনবেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ’র কণ্ঠে- সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো, ভাবি মনে মনে….।আর এ গানটির জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন নোয়াখালী থেকে সারওয়ার-ই আলম ও আরো অনেকে। এরপর বাজানো হতো পুরো গানটি। গভীর মুগ্ধতা নিয়ে গানটি শুনতাম আর কল্পনায় হারিয়ে যেতাম এমন কারো খোঁজে যাকে এমন একটি গান নিবেদন করা যায়। সে কী উত্তেজনা! রেডিওতে নাম ঘোষণা হবে। আমি ছিলাম অনুরোধের আসর চাওয়া পাওয়ার নিয়মিত শ্রোতা ও পত্রলেখক।
আমার পছন্দের এক বিরাট জায়গা জুড়ে ছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। কখনো কখনো অনুরোধ জানাতাম- যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়, সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়, সে চেনামুখ কতদিন দেখিনি, তার চোখে চেয়ে স্বপ্ন আঁকিনি- এ গানটির জন্য। কখনোবা-একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, আবার কখনো- একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল, আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল….। যেদিন গানটি প্রচারিত হতো তার পরের কিছুদিন কারণে অকারণে হাঁটতে চলতে ঐ গানটি গাইতাম, গুনগুন করতাম। অদ্ভূত ভাললাগায় হারিয়ে থাকতাম।কখনো গ্রামের মেঠোপথ ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে গাইতাম- প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ …….।
আমার নিরানন্দ কৈশোরে যে ক’জন শিল্পীর গান শুনে আমি মোহিত হতাম, শাহনাজ রহমতুল্লাহ তাদের অন্যতম। আমার মনের মুকুরে সৃজনশীলতার বীজ বপন করে দিয়েছেন যে ক’জন শিল্পীর সুরসুধা শাহনাজ রহমতুল্লাহ তাদের একজন। তাঁর গানগুলো আমাকে ভালবাসার তীব্রতায় ব্যাকুল করেছে কখনো, আবার কখনো করেছে দারুণ দেশপ্রেমিক। আমার এবং আমাদের সময়ের তরুণদের চিন্তার জগতকে একটি সুস্থ্য ধারায় প্রবাহিত হতে যে ক’জন শিল্পীর গান বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল শাহনাজ রহমতুল্লাহ তাদের একজন।
আজ এ কালজয়ী শিল্পীর প্রয়াণে তাঁর গান দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই-
যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়, সে হারালো কোথায়, কোন দূর অজানায়…….!