প্রচ্ছদ ফিচার রমজানের স্মৃতিকথা

রমজানের স্মৃতিকথা

0
মরিয়ম চৌধুরী: অনেক বছর ধরে দেশের বাইরে। আর সে জন্যই রমজান মাস এলে ছোটবেলায় রোজা রাখার পুরনো স্মৃতিরা এসে মনের জানালায় উঁকি দেয়। খুব বেশি মনে পড়ে আমার ছোটবেলার রমজানের দিনগুলো।
আমাদের ছোটবেলায় রমজান মাসটা খুবই আনন্দের, নির্মল ও পরিপাটি ছিল। রমজান আসলেই আমরা সব ভাইবোন আর বান্ধবীদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার থাকতো, কে কয়টা রোজা রাখলাম এটা নিয়ে। আম্মা আমাদের বেশি রোজা রাখতে দিতেন না ছোট থাকার কারণে, আর তাই সেহরিতে প্রত্যেক রাতে আমাদের ডাকা হতোনা। আমি আব্বাকে অনেক রিকুয়েস্ট করে ঘুমাতাম সেহরির সময় ডেকে তোলার জন্য। আব্বা আমাদের অনেক বেশি আদর করতেন বলে না করতে পারতেন না। ডেকে তুলতেন সেহরির সময় । তবে বলতেন তোমরা এখনো ছোট তাই তোমরা অর্ধেক দিন রোজা রাখলে রোজা হয়ে যাবে। কোন কোন রাতে আব্বা ডেকে তোলার আগেই মসজিদের মাইকে সেহরি খাওয়ার আহবানে জেগে উঠতাম আমরা। ভাই-বোন সবাই মিলে খুব আনন্দের সাথে সেহরি খেয়ে নামাজ পড়ে সবাই ঘুমাতে যেতাম।
আমি আর আমার ছোট বোন ঘুমাতামনা,। আমরা বসে থাকতাম বিছানার পাশে জানালার ধারে, সকাল হওয়ার মনোরম দৃশ্য দেখবো আর পাখিদের ঘুম-ভাঙানির গান শুনবো বলে। কি অদ্ভুত সুন্দর যে লাগতো সেই সকাল হওয়ার দৃশ্য। পরম আনন্দে পরিতৃপ্ত চোখ নিয়ে উপভোগ করতাম প্রকৃতির ঘুম ভাঙার দৃশ্য। কারণ রমজান মাস ছাড়া এভাবে ভোর হওয়া দৃশ্য দেখা হয়ে উঠত না। কোন কোন ভোরে আমরা দুই বোন নি;শব্দে দরজা খুলে বাইরে বের হতাম আর বিস্মিত চোখ আর আগ্রহী মনে সুন্দর সোনালী সকাল হওয়ার দৃশ্য অনুভব করতাম। অনুভব করতাম ভোরের নির্মল বাতাসকে, অনুভব করতাম পাখিদের ঘুম ভাঙ্গানোর গানে গানে মুখরিত জনমানব হীন চারিদিক। শুধইু প্রাকৃতির ঘুম ভাঙার শব্দ ছাড়া আর আর কোন শব্দ থাকতো না চারিদিকে। সবাই যখন ঘুমে আছন্ন, তখন অনাবিল এক আনন্দে দুই কিশোরী ঘুরে বেড়াতো বাড়ির চারিদিকে। কিছুক্ষণ কুয়ার পাশে জাম গাছের নীচে আবার কখনো বা আম গাছের নীচে। শেষ রাতের বাতাসে পড়ে যাওয়া আমগুলো কি যে আনন্দে কুড়াতাম সেই অসম্ভব সুন্দর অনুভূতিটা এখন আর লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। নিজের হাতে লাগানো ফুলের বাগানের সামনে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকতাম সদ্য ফোটা ফুলের দিকে, কি যে এক অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে উঠত।ছোট্ট একটা কলি থেকে সুন্দর ফুলের জন্ম দেখে।
কি যে নির্মল আর পবিত্র ছিল সেই আনন্দের অনুভূতি। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার ছিল তখন আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম আমরা আসার একটু আগেই ফুলপরীরা এসে ফুল ফুটিয়ে গেছে। মনে মনে আফসোস করতাম আরেকটু আগে আসলে হয়তো ফুল পরীর সাথে দেখা হয়ে যেত। কি যে খুশি হতাম এটা ভেবে যে ফুলপরিরাই এসে ফুল ফুটি য়ে গেছে। কি নিষ্পাপ আর নির্মল চিন্তাধারা ছিল ছোটবেলার।
অদ্ভুত ধরনের সুন্দর ছিল ছোটবেলার সেই ভোর হওয়ার দৃশ্যটা।
বাইরে কিছুক্ষ ঘুরাঘুরি করেএসে ঘুমিয়ে যেতাম কিছুক্ষণের জন্য। কোন কোন দিন অসহ্য গরমের কারণে আম্মা রোযা ভাঙতে বলতেন।আমরা বলতাম কোন রকমেই রোজা ভাঙ্গব না। তখন মা চাচীদের দেওয়া পরামর্শে রোজাকে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কলসির মধ্যে রেখে নারিকেলের টালার ঢাকানা দিয়ে ডেকে কিছু খেয়ে আবার তাড়াহুড়া করে ওই কলসির ঢাকনা তুলে কলসিতে মুখ লাগিয়ে সেই কলসী থেকে রোজা তুলে নিতাম। এখন এসব ভাবলে অবাক লাগে। তবে তখন কিন্তু সত্যিই বিশ্বাস করতাম এই ভেবে রোজা কলসিতে রেখে কিছুক্ষণের জন্য রোজা ভেঙে খেয়ে আবার রোজা রাখা যায়।
ছোটবেলার রোজার দিনগুলো ছিল আনন্দের ও সুখের। কোন ধরনের চিন্তা নাই, শুধু সময় মত নামাজ পড়া আর অবিরাম খেলাধুলা ও গল্পের বই পরে সময় কাটানো। তবে দিনের বেশিরভাগ সময়ই ভাই-বোনেরা সবাই মিলে কেরাম বোর্ড খেলতাম। উদ্দেশ্য ছিলো সময় কাটানো। কি যে আনন্দ উল্লাসের মাঝে আমাদের দিনটা কাটতো।
রমজান মাসের সবচেয়ে আনন্দের ছিল ইফতারের সময়টা। যেহেতু আমরা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি তাই সবাই মিলে এক এক সাথে কাটানো রমজান মাসটা ছিল অকল্পনীয় সুন্দর। সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারের সময় আম্মা যা-ই রান্না করতেন তা অমৃতের মত লাগত। আর সবাই মিলে এক সাথে খাওয়ার কারণেই আরো বেশি সুস্বাদু লাগতো।
একটা মজার ব্যাপার ছিল ইফতারের কিছুক্ষণ আগে বরফ ওয়ালা আসত বরফ নিয়ে, আমরা কি আনন্দে ওই কেনা বরফের টুকরা দিয়ে বানানো শরবত পান করতাম। আর আব্বা বাজার থেকে জিলাপি, বাখরখানি আরও নানান ধরনের ইফতারি নিয়ে আসতেন কি যে আনন্দ লাগতো আব্বার হাতে ইফতারের প্যাকেট গুলো দেখে। কি যে সুস্বাদু ছিল আব্বার বাজার থেকে কিনে আনা আর মার হাতের বানানো ইফতার।
আজ আমার ইফতারের টেবিলে নানান ধরনের ইফতার। কত ভিন্ন স্বাদের ইফতার তৈরি করি কিন্তু সেই সময়ের ভাইবোনরা সবাই একসাথে বসে মায়ের হাতের বানানো ইফতার, বরফ ওয়ালার বরফ দিয়ে বানানো শরবত বা বাবার কিনে আনা জিলাপি, বাখরখানির স্বাদের এর কাছে এ সবকিছু যেন বিস্বাদ মনে হয়।
ছোটবেলার স্মৃতি গুলো খুবই মধুর। এ রকম মধুর ছোটবেলার স্মৃতি কমবেশি সবারই জীবনেই আছে। আর সে জন্যই হয়তো আমরা অনেকে প্রায়ই বলি ,“ইস আবার যদি সেই ছোটবেলাতে ফিরে যেতে পারতাম”? তা হলে অনেক মজা হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব না। তবে এটাও কম কিসে? স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা আমাদের ছোটবেলা ঘুরে আসতে পারি “আলহামদুলিল্লাহ” যান্ত্রিক জীবনে এটাও তো অনেক বড় পাওয়া।
আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাদের সবার রোজাগুলো কবুল করুন আর সর্বদা নেক রাস্তায় চলার তৌফিক দান করুন। আমিন!