দিল মনোয়ারা মনু :শারাহ বানু শুচি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যার অবদানের কথা সেভাবে ওঠে আসেনি। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। একাত্তরে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন যুদ্ধ করার জন্য। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছিলেন। একাত্তরে পুরো বছরটাই কেটেছে শুচির পথে পথে। অগ্নিঝরা মার্চে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ তৈরির কাজে যুক্ত হন তিনি। এপ্রিলে বাংলার নিভৃত গ্রামবাসীর সঙ্গে থেকে পাকবাহিনীকে পিছু হটাবার লড়াইয়ে অংশ নেন। মে মাসে ভারতে চলে যান। তখন থেকেই তার মধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার আকুলতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ১৯৭১-এ তিনি ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রী ছিলেন। শুচির মা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বেগম সেলিনা বানু। তিনি একজন সমাজসেবক এবং এক কথায় একজন আলোকিত নারী। সারা জীবন ধরে আলো ছড়িয়েছেন তিনি। ‘এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের বাসায় স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। যে পতাকা শিবনারায়ণ দাস নিজ হাতে তৈরি করে তাকে দিয়েছিলেন। ২৩ মার্চেই বাসার ছাদে উত্তোলন করা হয়েছিল সেই পতাকা।
শারাহ বানু শুচি তখন মির্জাপুর, টাঙ্গাইলে ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের হোস্টেলে থাকেন, বঙ্গবন্ধুর ডাক তখন পৌঁছে গেছে সেই কলেজের মেয়েদের মধ্যেও। ওরা প্রস্তুত হল এ যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। জীবনের ঝুঁকি থাকবে কিন্তু কিছুতেই পিছু হাঁটা যাবে না। কিন্তু অস্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে? প্রশিক্ষণ অনেকেরই আছে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কচিকাঁচা মেলার সুবাদে রাইফেল ট্রেনিং, ফাস্ট এইড ট্রেনিং গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তখনকার গার্লস গাইডেও শেখানো হয়েছিল জরুরি রোগী নেয়ার নানা পদ্ধতি, আগুন নিভানো বা জরুরি অবস্থা মোকাবিলার। এ মানসিকতা নিয়ে তারা হোস্টেলের মেয়েরা মির্জাপুরে এক মিছিল ও প্রতিরোধ সভা করেন। সেই দিন কাকতালীয়ভাবে মওলানা ভাসানী সন্তোষ হয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন- তোরাও আন্দোলনে নেমেছিস? তাহলে দেশতো স্বাধীন হবেই। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন তারা। কিন্তু পঁচিশে মার্চের আগেই হোস্টেল বন্ধ করে দেয়া হয়। মেয়েরা যে যার বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। শুচিও ঢাকা হয়ে কুমিল্লায় আসেন। পথে জয়দেবপুর ক্যান্টমেন্টে আগুন জ্বলতে দেখেন। শুনতে পান গুলি চলছে, এমন অবস্থায় তার ঢাকা আসাই দুষ্কর হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে শারাহ বানু শুচি বলেন, তখনই দেখেছি সাধারণ মানুষের শক্তি। আমাদের বাস ড্রাইভার গাড়ি এমনভাবে টান দিলেন যে, আমরা দ্রুত সে জায়গা অতিক্রম করে চলে এলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় দু’মাস দেশের ভেতরই ছিলাম, তখন দেখেছি এ দেশের রিকশাওয়ালা, মাঝি ও বাস ড্রাইভারদের সাহস এবং দেশপ্রেম। নিজের জীবনের পরোয়া না করে কীভাবে যাত্রীদের নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে গুলি খাওয়ার পরও তারা পিছু হটেননি।
১৯৭১-এর পঁচিশে মার্চের রাতে কুমিল্লার টমসন ব্রিজে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা ভাই-বোনেরা এক প্রতিরোধ তৈরি করেন। শারাহ বানু শুচিও সেখানে ছিলেন, সন্ধ্যার পর তারা চলে আসেন। পাকবাহিনী রাতের গভীরে কুমিল্লা শহরে ঢোকে এবং পুলিশ লাইনে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর গুলি চালায়। টমসন ব্রিজের কাছেও এক সময় গুলিবর্ষণ করে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা দূরে লুকিয়ে থাকায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি সেদিন হয়নি। কিন্তু পুলিশ লাইনে প্রচুর পুলিশ মারা যান। মুক্তিযোদ্ধারা তখন পুলিশ লাইনের কাছে জমায়েত হয়ে সোগান দিয়ে পুলিশবাহিনীকে সাহস দিচ্ছিলেন। প্রতিরোধ কমিটি চেষ্টা করছিল পুলিশ লাইন থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার, কারণ যে অস্ত্র তারা পেয়েছিল তা পর্যাপ্ত ছিল না। রাত দু’টার দিকে পাকহানাদার বাহিনী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। বহু মানুষকে বন্দি করে, কুমিল্লার টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন করে দেয়।
শারাহ বানু শুচির বাসায় সে রাতেই আক্রমণ হয়। কুমিল্লার নিরুপমা স্টোরের মালিকসহ আরও অনেকের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে ছিল সেদিন। বাসায় শুচি ও তার বড় বোন মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল না থাকায় তারা বেঁচে যান। কিন্তু পাকহানাদাররা তার মা সেলিনা বানুকে ধরার জন্য ওই বাসায় ২৬ ও ২৭ মার্চ দু’বার হানা দেয়। কারণ তাদের জনপ্রিয় মা ১৯৫৪ সালে ন্যাপের যুক্তফ্রন্টের টিকিটে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি তখন কচিকাঁচার মেলাসহ নানা সামাজিক কাজেও নিয়োজিত। পাকসেনারা প্রথম প্রহরে আক্রমণের উদ্দেশ্যেই তাদের বাসায় শেল, গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণ করে।
শুচিদের হাতে যে সব অস্ত্র ছিল তা দিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। সে জন্য তারা দ্রুত ট্রেনিং নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসার সংকল্প নেন। প্রথমে তারা ভারতে না গিয়ে কুমিল্লার বুড়িচংয়ে ক্যান্টনমেন্টের পিছনের একটি গ্রামে আশ্রয় নেন। সেই রাতেই ওই গ্রামে কিছু সুবেদারের পরিবার ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসে। পাকবাহিনী তাদের ওপর হামলা করে সারা গ্রাম তছনছ করে। গ্রামের সামনের এক টিলায় কামান স্থাপন করেছিল পাকবাহিনী। সেটি ঘণ্টায় ঘণ্টায় চারদিকে ঘুরিয়ে গোলাবর্ষণ করছিল। এমন অবস্থার মধ্য দিয়েই শুচিরা গ্রাম ছাড়ে। এপ্রিলে আবার পাকসেনার হামলার শিকার হয় তারা। কিন্তু এবারও বেঁচে যায় আশ্চর্যজনকভাবে। সে রাতেই শারাহ বানু শুচি জানতে পারেন বড়বোন শিরিন বানু মিতিল পুরুষের পোশাকে পাবনার রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। তার ভাইদের সঙ্গে পাবনায় প্রতিরোধবাহিনীর একজন হয়ে অস্ত্র হাতে পাবনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ রক্ষায় কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
শারাহ বানু শুচি জুলাই মাসে কলকাতায় যান। ভারতের আগরতলা, সোনামুরাসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করেন তিনি। তারপর আগরতলার ক্রাফসট হোস্টেলে প্রচুর নারী মুক্তিযোদ্ধা ও ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে একই হোস্টেলে অবস্থান করেন। এটি ছিল একটি অস্থায়ী ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে সেখানে আসতেন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে তারা বিভিন্ন স্থানে চলে যেতেন।
এ প্রসঙ্গে শুচি বলেন, অনেক অল্পবয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি তারা আশ্রয় চাননি, অস্ত্র চেয়েছেন। শুচিরাও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সেবামূলক কাজই শুধু নয়, চিকিৎসার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসক ছিলেন, যেমন- ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না, ডা. ফাওজিয়া মোসলিম। শারাহ বানু শুচি জুলাই মাসেই কলকাতার গোবরা ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য যান। ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের অনেক জায়গা শত্রুমুক্ত হলেও ঢাকা তখনও পাকবাহিনীর দখলে। শুচি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ১৬ ডিসেম্বর যশোরে অবস্থান করছিলেন। তারা জানতে পেরেছিলেন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করছে। স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন তিনি। এসে দেখেন, এই যুদ্ধে তার দাদাবাড়ি, মামাবাড়ির অনেকেই শহিদ হয়েছেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের একটি স্মরণীয় স্মৃতি বলতে গিয়ে শারাহ বানু শুচি বলেন, আগরতলায় ইন্দিরা গান্ধীকে সামনাসামনি দেখেছি। তার কাছে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র চেয়েছিলাম। তিনি যতদূর সম্ভব তা করেছেন।