আবু হেনা আবদুল আউয়াল: ব্রিটিশ শাসকেরা বাঙালিদের ভীতু, অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ মনে করে সেনাবাহিনীতে নিত না। কিন্তু ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া বিশ্বযুদ্ধ যখন বিশ্বের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, তখন বেশিসংখ্যক সৈন্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পটভূমিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৬ সালে বাঙালিদের নিয়ে গঠন করে বাঙালি ডবল কোম্পানি। এ কোম্পানির গঠন সম্পন্ন হয় ১৬ ডিসেম্বর।
বাঙালি ডবল কোম্পানিতে সৈন্য সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় মহকুমায় রিক্রটিং কেন্দ্র খোলা হয়। জমিদার, রাজনৈতিক নেতা ও সমাজপতিরা সভা-সমাবেশ করে বাঙালি যুবকদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ডাক্তারি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষান্তে প্রার্থী বাছাই করা হয়। ঘোষণা দেয়া হয় : যত দিন যুদ্ধ চলবে তত দিন তাদের সেনাবাহিনীতে রাখা হবে। তবে যুদ্ধান্তে কেউ যদি বাহিনীতে থাকতে চায় তা পরে বিবেচনা করা হবে। প্রথমে তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য করাচির নৌশেরায় পাঠানো হয়। ট্রেনিংয়ে ভালো করলে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। ট্রেনিংকালে যোগ্যতা ও পারদর্শিতা দেখানোয় কারো কারো উপরের দিকেও প্রমোশন দেয়া হয়।
নৌশেরায় তাদের পর্যায়ক্রমে ট্রেনিং দেয়া হয়। ড. এসএম লুৎফর রহমান তার ‘মেসোপটেমিয়ায় নজরুল’ গ্রন্থে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর পত্র উদ্ধৃত করেছেন, যাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ট্রেনিংয়ের বিবরণও পাওয়া যায়; ‘বাঙালি পল্টনের সৈন্যদিগকে প্রতিদিন ভোর ৫টা হতে সাড়ে ৫টার মধ্যে ঘুম হতে উঠিয়া হাত মুখ ধুইতে হয়। ৬টার সময় চা-হালুয়া খাইতে পাওয়া যায়। ৬টা হইতে ৭টার মধ্যে তাহাদিগকে পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করিতে হয়। বেলা ৭টার সময় তাহারা ব্যারাকের নিকটে প্যারেড করিবার জন্য শ্রেণীবদ্ধভাবে একত্রিত হয় এবং সেখান হতে মার্স করিয়া প্যারেড স্থানে গমন করে। সেখানে ৭টা হতে ৯টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা সময় প্যারেড করিতে হয়। যাহারা এ পর্যন্ত ‘টার্গেট’ পাস করেন নাই, তাহাদিগকে ১০টা হইতে ১১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টাকাল লক্ষ্যস্থির শিক্ষা করিতে হয়। সিগন্যালারদিগকে ১২টা হতে ১টা ও ৪টা হতে ৬টা পর্যন্ত সিগন্যাল অভ্যাস করিতে হয়। কলের কামান চালকদিগকে ২টা হইতে ৪টা পর্যন্ত কামান চালনা শিক্ষা করতে হয়। অন্যান্য সকলের ৪টা হইতে ৬টা পর্যন্ত শারীরিক ব্যায়াম, অবস্টেক কোর্স ট্রেনিং ও স্কোয়ার্ডেড ড্রিল শিক্ষা দেওয়া হয়।’
এ ছাড়াও তাদের আরো অনেক কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলতে হতো। যুদ্ধের তীব্রতার আশঙ্কায় ও বাঙালি ডবল কোম্পানির সৈন্যদের দক্ষতা ও সাহসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় বাঙালিদের মধ্য থেকে আরো সৈন্য নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তারই ফলে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে বাঙালি সৈন্য ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করে। এবারও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ও বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানে সভা-সমাবেশ করে বাঙালি ছাত্র-যুবকদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এবারও সৈন্যবাহিনীতে যোগদানকারীদের জমিদার ও সরকার থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা দানের ঘোষণা দেয়া হয়। এ ছাড়া, স্কুলের শিক্ষকরা ও রাজনৈতিক নেতারা ছাত্র-যুবকদের আবেগময় ভাষায় স্কুলের সুনাম, জাতির গৌরব ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে ও যুদ্ধে যেতে আহ্বান জানান।
১৯১৭ সালের জুলাই থেকে ৪৯ বাঙালি পল্টনে সৈন্য ভর্তি শুরু হয়। সে সময় কাজী নজরুল ইসলাম দশম শ্রেণীর ছাত্র সেয়ারশোল রাজ ইংলিশ হাইস্কুলে। সামনে প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা। খুব ভালো ছাত্র; সে জন্য হোস্টেল চার্জ ফ্রি। স্কুল থেকে পান মাসিক পাঁচ টাকা, যা ম্যাট্টিকুলেশন পরীক্ষার শেষ পর্যন্ত চলতে থাকবে। এসব সুযোগ-সুবিধা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ছেড়ে তিনি সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। এ সম্পর্কে নজরুল নিজেই লিখেছেন, ‘ক্লাসে ছিলাম ফার্স্ট বয়। হেড মাস্টারের বড় আশা ছিল- আমি স্কুলের গৌরব বাড়াব, কিন্তু এ সময় এলো ইউরোপের মহাযুদ্ধ। একদিন দেখলাম, এদেশ থেকে লোক পল্টনে যাচ্ছে যুদ্ধে। আমিও যোগ দিলাম এই পল্টন দলে।’ নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গেলেন কেন? নিশ্চিত জবাব পাওয়া না গেলেও মুজফফর আহমদের অনুমানই ঠিক। তিনি তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বেঙ্গলি ডবল কোম্পানিতে পরে বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যে বাঙালি যুবকরা যোগ দিয়েছিলেন তাদের সকলের মনে কি ছিল তা জানিনে, তবে বহুসংখ্যক লোক ভেবেছিলেন যে, এটা একটা দেশপ্রেমের কাজ। নজরুল ইসলামও এই বহুসংখ্যকের একজন ছিল।’ উল্লেখ্য, নজরুল তখন মাত্র আঠারো বছরের টগবগে যুবক প্রাণোচ্ছল, উদ্দীপিত, মেধাবী, দেশপ্রেমে ভরপুর।
নজরুল খুব সম্ভব আগস্ট-সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। ভর্তির পরে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। সেখান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় নৌশেরায়। কলকাতা রেলস্টেশনে তাদের বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। নজরুল তার ‘রিক্তের বেদন’ গল্পগ্রন্থে ট্রেনযাত্রার কিছু খণ্ড চিত্র তুলে ধরেন এভাবে, ‘সবচেয়ে বেশি ভীড় হয়েছিল কলকাতায় আর হাওড়ার স্টেশনে। ওঃ সে কি বিপুল জনতা আর সে কি আকুল আগ্রহ আমাদের দেখবার জন্যে! আমরা মঙ্গলগ্রহ হতে অথবা ঐরকমেরই স্বর্গের কাছাকাছি কোনো এক জায়গা হতে যেন নেমে আসছি আর কি। যাদের সঙ্গে কখনো আলাপ করবারও সুযোগ পাইনি। তারাও আমাদের সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন আর অশ্রু গদগদ কণ্ঠে আশিস করেছেন।’
তিনি নৌশেরায় তিন মাস সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির মতো পূর্বোক্ত ট্রেনিং বা সামরিক প্রশিক্ষণ ৪৯ বাঙালি পল্টনকেও পর্যায়ক্রমে দেয়া হয়। কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও যুদ্ধবিদ্যার সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনিও পল্টনের সঙ্গে করাচিতে যান।
উল্লেখ্য, পল্টনের সদর দফতর ছিল করাচিতে। তার সৈনিক জীবনের অধিকাংশ সময় এ করাচিতেই কাটে। প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ পরবর্তী কর্মকাণ্ডে কৃতিত্ব দেখান তিনি। ফলে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েকটি পদোন্নতি পেয়ে ‘ব্যাটেলিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার’ হন। তার এ পদোন্নতি বাঙালি সৈনিকদের জন্য ছিল পরম গর্বের। নজরুল সেনাবাহিনীতে গেলেন যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু তাকে যুদ্ধ করতে হয়নি। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তখন বাঙালি পল্টন ভেঙে দেবার কথাবার্তা চলতে থাকে। পরে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেয়া হয়। নজরুল ফিরে আসেন কলকাতায়। এখানে তিনি পূর্ণোদ্যমে জড়িত হন সাহিত্যচর্চায় ও সাংবাদিকতায় এবং কিছু দিন পরে রাজনীতিতেও। সে আরেক ইতিহাস। বাল্য-কৈশোরে নজরুল যে কাব্যচর্চা শুরু করেন, করাচি সেনাবাসেও তিনি তা অব্যাহত রাখেন। সেনাবাহিনীতে তিনি রসদ সরবরাহ দফতরে ছিলেন। সময় করে তিনি সেখানে গল্প কবিতাদি লিখতেন। সেখান থেকে তিনি কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার গ্রাহক হন ও বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠান। সেই লেখা পাঠানো সূত্রে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও মুজফফর আহমদ প্রমুখের সঙ্গে তার পত্র যোগাযোগ ও পরিচিতি গড়ে ওঠে।
নজরুল করাচি সেনানীবাসে বসে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। সেগুলোর মধ্য থেকে তিনি কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠান। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে নতুন ও অপরিচিত হওয়ায় অল্পসংখ্যক পত্রিকায় তার অল্প সংখ্যক লেখা প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো পত্রিকায় যেমন ‘সবুজপত্র’ তার লেখা প্রকাশ করেনি। তার প্রথম প্রকাশিত গদ্য ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ যা মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন সম্পাদিত সওগাতে মুদ্রিত হয়। এটি করাচি সেনানিবাস থেকে প্রেরিত। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’, যা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সম্পাদিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। এটিও করাচি সেনানিবাস থেকে প্রেরিত। এভাবে করাচি সেনানিবাস থেকে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রেরিত নজরুলের বিভিন্ন ধরনের প্রকাশিত লেখার সংখ্যা ছাব্বিশ-সাতাশ। প্রেরিত কত লেখা যে ঠিকমতো ডাকে পৌঁছেনি, কত লেখা যে পেপার বাস্কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে, কত লেখা যে হারিয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। উক্ত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার’ সম্পাদককে লিখিত পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘যদি কোনো লেখা পছন্দ না হয়, তবে ছিঁড়ে না ফেলে এ গরিবকে জানালেই আমি এর নিরাপদে প্রত্যাগমনের পাথেয় পাঠিয়ে দেব।’ আরো লিখেছেন সৈনিক জীবন ও সে জীবনে লেখালেখি সম্বন্ধে, ‘কারণ সৈনিকের বড্ড কষ্টের জীবন। আর তার চেয়ে হাজার গুণ পরিশ্রম করে একটু আধটু লেখি। আর কারুর কাছে এ একেবারে Money-Value হলেও আমার নিজের কাছে ওর দাম ভয়ানক। […] আমাদের এখানে সময়ের গড়হবু-ঠধষঁব; সুতরাং লেখা সর্বাঙ্গ সুন্দর হতেই পারে না।Undisterbed Time মোটেই পাই না। আমি কোনো কিছুরই কপি বা Duplicate রাখতে পারি না। সেটি সম্পূর্ণ অসম্ভব।’
নজরুল সেনানিবাসে বসে লেখালেখির পাশাপাশি প্রচুর লেখাপড়াও করেছেন। সুযোগ পেলেই তিনি এসব কাজে বসে যেতেন। সেখানে তিনি এক ফারসি মৌলবীর কাছে ভালোভাবে ফারসি শেখার সুযোগ পান। ফলে ফারসি কবিতা পড়তে ও বুঝতে তার সুবিধা হয়। সেখানে বসেই তিনি হাফিজের ‘দিওয়ান-ই হাফিজ’ পড়ে ফেলেন ও সেখান থেকে কিছু কিছু বাংলায় অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করেন। সেখানে বিভিন্ন গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রও শেখেন তিনি। সেখানে বসেই তিনি রুশ বিপ্লবের খবর পান ও আনন্দ প্রকাশ করেন। তার ‘ব্যথার দান’ গল্পে এর প্রতিফলন ঘটেছে।
নজরুলের সৈনিক জীবন তথা করাচি জীবন নিয়ে লেখালেখি বা গবেষণা হয়নি বললেই চলে। এখন সময় এসেছে এদিকে দৃষ্টি দেয়ার। এ বছর নজরুলের সেনাবাহিনী তথা ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দেয়ার শতবর্ষ পূর্তি। একজন বাঙালি কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেনাজীবন সেনাবাহিনীর জন্যও গর্ব-গৌরবের।