প্রচ্ছদ প্রবন্ধ প্রেসক্লাবের ইলিশ খিচুড়ি

প্রেসক্লাবের ইলিশ খিচুড়ি

0
এম এ হাসনাত খান: বহুদিনের ইচ্ছা ছিলো লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে গিয়ে এক টুকরো ইলিশ দিয়ে এক গামলা পান্তা খাবো। সাথে এক পিস ইলিশের ডিম হলে…..আহা! কিন্তু ২০১৯ সালের আগে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের বর্ষবরণের কোন অনুষ্ঠানে আমি দাওয়াত পাইনি। তাই যাবো যাবো করেও আর যাওয়া হয়নি। এর কারণ আমি বিশিষ্ট পেটুক। তবে পেটুক হলেও আমার একটা সন্মান আছে। এ কারণে দাওয়াত ছাড়া কোথাও যাইনা। তাছাড়া দাওয়াত ছাড়া গেলে পেট পুরে খাওয়াও যায়না। পেটুক আর ভোজনরসিকের মধ্যে তফা্ৎ আছে। ভোজনরসিকরা বাছবিছার করে খায়, পেটুকরা যা পায় তাই খায়। আমি মন ভালো থাকলে মনের আনন্দে খাই। মন খারাপ থাকলে মনের দু:খে খাই। শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, হেঁটে কিংবা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে যেকোন ভাবে খেতে আমার আপত্তি নাই।
আমিই সম্ভবত একমাত্র মানুষ যার চকলেট খাওয়ার পর চকলেটের সাথের ফুয়েল পেপারটাও খেয়ে ফেলতে মন চায়। বাজি ধরে বিচারপতি মানিকের দশখানা ভিজিটিং কার্ড চিবিয়ে খেয়েছিলাম একবার। তবে আমি কখনোই একলা খাই না, আমার জামা কাপড়, লেপ তোষক, বিছানা বালিশ, বই খাতা, টেবিল চেয়ারও আমার সাথে খায়। আমার খাওয়ার ধরণ দেখে কয়েক মাস না খেয়ে আছি বলে কারো সন্দেহ হওয়া স্বভাবিক।

খাওয়া দাওয়া নিয়ে প্রচলিত ধারণা সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধাবোধ  খুবই কম। কারণ মানুষ বাঁচার জন্য খায়, আমি খাওয়ার জন্যই বাঁচি। ভাবি খাবার না থাকলে এই পৃথিবীর কি হতো! এত যুদ্ব বিগ্রহ মারামারি কাটাকাটি সবই বৃথা যেতো! যদি খাবার না খেতে হতো এ সবই অর্থহীন হয়ে যেতো! খাবার ছাড়া যুদ্বজয়, বিয়ে, পূজা, পার্বণ, নববর্ষ মানুষ কি দিয়ে উদযাপন করতো? এ কারণে সম্রাট আকবরের আমল থেকে পয়লা বৈশাখের প্রচলন শুরু হলেও নববর্ষ নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ নাই। প্রতিদিনের মতো এ দিনটিও যথা নিয়মেই শুরু হয়। তাই আমার যত আগ্রহ ওই পান্তা-ইলিশে। আমার কাছে পহেলা বৈশাখ মানেই যেন পান্তা-ইলিশ ভক্ষণ।

 

লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের দাওয়াত কার্ডে ইলিশ-খিচুড়ি খাওয়ার নিমন্ত্রণ দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম! তবে যতটা না অবাক হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি খুশিই হয়েছিলাম ইলিশ-খিচুড়ি আমার খুবই প্রিয় খাবার বলে। ইলিশ-খিচুড়ি যে শুধু আমারই প্রিয় খাবার তাই না। বৃষ্টির রাতে ফেইসবুক খুললেই দেখা মিলছে, বিভিন্ন হোটেলে চেকইন দিয়ে ‘এই বৃষ্টিময় রাতে অমুক হোটেলে তমুকের সঙ্গে ইলিশ-খিচুড়ি খাচ্ছি‘, কেউ কেউ তো আকাশে মেঘ দেখলেই চুলায় খিচুড়ি তুলে দিয়ে ইলিশ ভাজার ছবি আপলোড দেন। অনেকে আরো একধাপ এগিয়ে ইলিশ-খিচুড়ির সঙ্গে সেলফি তুলে পোস্ট দেন। এসব দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা!
নববর্ষে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণ এটা যেমন এক প্রকার ঐতিহ্য, তেমনিভাবে ইলিশ-খিচুড়ি ভক্ষণও একটি মহাঐতিহ্য। যদিও এই ইলিশ-খিচুড়ি ভক্ষণ ঐতিহ্য কোন সম্রাটের আমল থেকে প্রচলন শুরু হয়, তা আজও জানা যায়নি! কিন্তু তাতে কি আসে যায়! আসল কথা হলো ভক্ষণ। আহ…ইলিশ! ইংরেজি ‘হিলশা’, বৈজ্ঞানিক নাম টেনুয়ালোসা ইলিসা। খান্দানি মাছ, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। উড়িষ্যার একটি প্রবাদ আছে, ‘মাছ খাও তো ইলিশ, চাকরি করো তো পুলিশ।’

বাঙালীর সব চাইতে প্রিয় মাছ ইলিশ। রাজনীতি, অর্থনীতি, কুটনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে বাঙালীর মতপার্থক্য থাকলেও কিন্তু ইলিশ বিষয়ে সকলেই একমত। ইলিশ ভালোবাসেন মুখ দেখাদেখি বন্ধ আমাদের দুই নেত্রীও। মন-কষাকষির এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন হলে কেমন হতো? প্রণব মুখার্জি  গণভবনের হেঁসেলে ঢুকে খুব যত্ন করে ভাপা ইলিশ রান্না করে বলছেন, মাননীয় দুই নেত্রী, এই ভাপা ইলিশ শুধুই আপনাদের জন্য। আপনাদের কিছুই করতে হবে না। আপনারা দু’জন একসঙ্গে বসে একই টেবিলে শুধু খাবেন। আর কিছু না। এমন হলে সম্ভবত তারা ওই ইলিশের জন্য হলেও একই টেবিলে বসতেন এবং একটু পর দেশের সকল সমস্যার জট একটু একটু করে খুলতেন।
ইলিশের উপর কোন কথা নাই। মাছ সমাজের ব্রাক্ষণ ইলিশ। ব্রাক্ষণরা হিন্দুদের মাঝে উঁচু জাত, তারা পৈতা পড়ে। অভিজ্ঞ রাধুনীরা হয়ত ইলিশ কাটার সময় খেয়াল করে থাকবেন, এর পিঠের দুই পাশে চিকন সুতার মত দুইটা সাদা দাগ। ইলিশের এই দুইটা দাগকে পৈতার সাথে তুলনা করতে পারেন। মাছের রাজা ইলিশ। বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে , রক্তে রক্তে ইলিশ। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু মাছ কোনটি? এক বাক্যে সবাই বলবেন,‘ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ‘। সম্রাট শাহজাহান যদি তাজমহল না বানিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য জীবদ্দসায় একটা ইলিশমহল বানাতেন আমার মনে হয় মমতাজ তাতে আরো বেশি খুশি হতেন।

 

এসব ভাবতে ভাবতেই রাতে ঘুমাতে গেলাম। স্বপ্নে দেখলাম, তাহের ভাই, গিয়াস ভাই, শোয়েব ভাই  লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের মেম্বার হইছেন। তাহের ভাই বন্ধু শিহাব ভাই, শোয়েব ভাই ও গিয়াস ভাইয়ের সাথে এক টেবিলে আড্ডা দিচ্ছেন। শিহাব ভাই ছড়ায় ছড়ায় সবাইকে ধাঁধা ধরছেন, ‘তুমি থাক জলে/আমি থাকি ডালে/দেখা হবে দুজনায়/মরণের কালে।’গিয়াস ভাই মাথা চুলকাচ্ছেন। তাহের ভাই ভেবে বলছেন,‘ কাঁচা মরিচ। শোয়েব ভাই আরেকটু যোগ করে বলেছেন,‘ পানির ইলিশ মাছকে উদ্দেশ্য করে কাঁচা মরিচ বলছে যে, দুজনের মরণের সময়, মানে একমাত্র রান্নার সময়েই তাদের দেখা হবে— তার আগে নয়।‘ শোয়েব ভাই-তাহের ভাইয়ের উত্তর সঠিক হয়েছে। সদ্য-ধরা পড়া ইলিশের পেটিতে মরিচ মাখিয়ে কড়াইয়ের গরম তেলে সামান্য নাড়াচাড়া করলেই যে রকম সারা পাড়া এক আশ্চর্য সুগন্ধে ম‘ ম‘ করে। শিহাব ভাই-তাহের ভাই-শোয়েব ভাই-গিয়াস ভাইয়ের টেবিলের চারপাশেও সেরকম সুগন্ধ মৌ মৌ করছে।
আরেক টেবিলে দেখলাম আনাস ভাই- কিবরিয়া ভাই এক সাথে বসে ইলিশ-খিচুড়ি খাচ্ছেন। আনাস ভাই কিবরিয়া ভাইয়ের মাছের কাটা বেছে দিচ্ছেন আর ইলিশ নিয়ে কমপ্লেইন করছেন। বলছেন,‘ রুপালি ইলিশের পেটের অংশে লালচে, সোনালি ছোপ—সেরা ইলিশ এটাই। পিঠ মোটা মাছটাই ভালো। ইলিশ মাছ কেনার সময় এমন নানা বিষয় বুঝতে হয়। কে যে মাছ কিনেছে?
ইলিশরা ভ্রমণপ্রিয় জাত। তারা মাছ হয়ে যে সময়ে যতটা পথ ট্রেক করে, মানুষ তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না। ইলিশরা যে প্রতি বছর স্রোতের উল্টো দিকে একটানা মাইলের পর মাইল সাঁতার কেটে যায়, সেটা কি তারা সমুদ্রে ফিরে গিয়ে পাড়ার ক্লাবে মানুষের মতো গল্প করে? নোনতা সমুদ্রপথে ঝাঁক-বেঁধে ভেসে যাওয়ার সময় এরা খাওয়া-দাওয়াও প্রায় কিছুই করে না। ফলে তখন চেহারাটাও বেশ খারাপ হতে থাকে। তার পর মিষ্টি জলের নদীতে পড়ার পর তারা শ্যাওলা জাতীয় খাবারদাবার খেতে শুরু করে। তখন ওদের স্বাস্থ্য আস্তে আস্তে ভাল হতে থাকে। শরীরে তেল ও চর্বি বাড়তে থাকে। স্বাদও বাড়তে থাকে হু হু করে।

এই কারণে সমুদ্রে বা মোহনার মুখে ধরা পড়া ইলিশের স্বাদের চেয়ে, ভরা-নদীতে জালে-পড়া ইলিশের স্বাদ আরও সরেস। নদীতে পড়ে এরা প্রচুর জল খায় আর রেচন অঙ্গ দিয়ে প্রচুর জল বের করে। ফলে তাদের তলপেটের পেশিগুলির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। আর ঠিক এই কারণেই গাদার থেকে ইলিশের পেটির পিসগুলিকে অনেক বেশি সুস্বাদু লাগে। এই নেন পেটির পিস খেয়ে দেখেন, এই কথা বলে আনাস ভাই কাঁটা বেছে কিবরিয়া ভাইয়ের মুখে তুলে দিচ্ছেন । কিবরিয়া ভাই খুব আরাম করে পেটির পিস খাচ্ছেন।
অন্য এক টেবিলে দেখলাম, আহাদ ভাই ইব্রাহিম ভাইকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন আর গল্প করছেন, ‘পন্ডিতেরা বলেন বৈশাখ মাসে সমসংখায় পুরুষ এবং মহিলা ইলিশ নদীতে  প্রবেশ করে কিন্তু পুরুষ ইলিশ নিজেদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সুরুত সুরুত করে জালের পরিধি হইতে কাটিয়া পড়ে ৷ পুরুষের এমত বুদ্ধি ? উঁহু – মানিতে পারা যায় না ৷‘ তাই শুনে পাশের টেবিল থেকে রুপী আমিন আপা বলছেন,‘ ইহা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হয় পুরুষ ইলিশ কাপুরুষ – মহিলাকুলকে বিপদের মুখে ঠেলিয়া নিজে পলায়ন করে৷‘ রুপী আপার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।

কিচেনের সবচেয়ে কাছের টেবিলে দেখলাম মিজবাহ ভাই বসে কৌতুক বলছেন। পলি আপা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন আর গরম তেলে মিজবাহ ভাইকে ইলিশ মাছের পেটি ভেজে দিচ্ছেন। তাই দেখে কেউ একজন মিজবাহ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলছেন,‘ কিচেনের কাছের টেবিলে বসার কারণ কি পলি না মাছের পেটি? মিজবাহ ভাই মাছের পেটিতে কামড় দিয়ে বলছেন, মাছের পেটি। আহ! ইলিশ মাছের পেটির কোন তুলনা নাই। যৌবনে স্বপ্ন ছিলো বিয়ে করবো, শ্বশুর হবে ইলিশ মাছের আড়তদার। গর্বভরে দশজনকে বলতে পারবো আমার শ্বশুর ইলিশ মাছের আড়তদার! মানে আমার শ্বশুরের ম্যালা টাকা। কিন্তু এর মাঝেই অস্টাদশী এক তরুণী আমাকে ইলিশ মাছের পেটি দিয়ে হাটুগেড়ে প্রপোজ করলো! এরপর আর না করতে পারলাম না। ডায়মন্ডের রিং দিয়ে প্রপোজ করলেও ফিরিয়ে দিতাম। কিন্তু ইলিশ মাছের পেটি কি করে ফিরিয়ে দেই- বলেন?‘ মিজবাহ ভাইয়ের কথা শুনে মিজবাহ ভাইয়ের জামাইও মাথা নেড়ে হাসছেন।
এক টেবিল পরেই তারেক ভাই আর সাত্তার ভাই বসেছেন। সাত্তার ভাই তারেক ভাইকে প্রশ্ন করছেন,‘ আপনি কিভাবে ইলেকশন জিতছেন, বলবেন? তারেক ভাই বলছেন,‘ ভোটের আগে আমার ভোটারদের আমি ইলিশ মাছের পেটি খাওয়াইছি।‘ সাত্তারকে ভাইকে দেখে মনে হলো তারেক ভাইয়ের কথায় বেশ ইন্সপায়ার হইছেন।

রহমত ভাই অনুষ্ঠানে তার সদ্য প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই নিয়ে এসেছেন। রহমত ভাইয়ের কবিতার বই পড়ে কেউ একজন তাকে প্রশ্ন করছেন,‘ ইলিশ মাছ নিয়ে আপনার বইয়ে কোন কবিতা নেই কেনো? আপনি কি ইলিশ পছন্দ করেন না? রহমত ভাই বসন্ত চৌধুরীর মত হাতে করে কাঁটা না বেছে, ইলিশের গাদার একখানি বড়সড় টুকরো ভেঙে মুখে পুরে, আনমনে খানিকক্ষণ চিবোনোর পর, সমস্ত কাঁটা একসঙ্গে মুখ থেকে বার করে দিতে দিতে বললেন,‘ রবীন্দ্রনাথ -নজরুলও তো ইলিশ নিয়ে কিছু লেখেন নি! রবীন্দ্রনাথ পদ্মার ওপর বোটে অনেক দিন চেপেছেন, মাঝে মাঝে কি ইলিশ চেখে দেখেননি? ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না‘ তে কিন্তু  ইলিশ মাছের রেসিপি আছে। কাজেই ইলিশ পছন্দ করলেই ইলিশ নিয়ে লিখতে হবে এমন তো কোন কথা নেই!
পাশ থেকে জুয়েল রাজ এই আলোচনায় যোগ দিলেন। তিনি বললেন,‘ রবীন্দ্রনাথের ইলিশ-প্রীতি সম্পর্কে কোনও তথ্য আমার জানা নেই। তবে স্বামী বিবেকানন্দর ইলিশ-প্রীতি বিশ্ববিখ্যাত। যেই রাতে স্বামীজি মারা গিয়েছিলেন সেই রাতে তিনি পেটপুর ইলিশ খেয়েছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তিনি একেবারে তাজা বা ভাজা ও রান্না করা ৯টি ইলিশ মাছ একেবারে খেতে পারতেন। একবারে ৯টা ইলিশ খাওয়ার কথা শুনে মাসুম ভাইকে দেখলাম আরো ১০০টা ইলিশের অর্ডার করছেন। শাহজাহান ভাইকে দেখলাম, সেই ইলিশ মাছ ভাজার জন্য ঘি নিয়ে এসেছেন। সবাই শাহজাহান ভাইয়ের ইলিশ ভাজার অপেক্ষা করছেন। উল্টা দিক থেকে তাইছির ভাই আমাকে ডাকছেন। এরকম ইলিশ মাছের স্বপ্ন দেখতে দেখতে তাইছির ভাইয়ের ডাকে আমার যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঠিক দুপুর।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এ দেখলাম, বার্মিংহাম থেকে মারুফ ভাই , জিয়া ভাই‘রা রওয়ানা দিয়েছেন। কথায় বলে মক্কার মানুষ নাকি হজ্জ পায়না। আমি তড়িঘড়ি বিছানা থেকে উঠলাম। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বপরিবারে ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নিমন্ত্রণ থাকায় সর্বভুক এক ছোট ভাইকে খবর দিলাম। খাবারের কথা শুনে সে লাফাইতে লাফাইতে চলে আসলো।

তাকে সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। স্টেশনের পাশে খাবারের দোকান দেখে সে বললো, ক্ষুধা লাগছে! তাকে বললাম, ৭.০০ টায় প্রোগ্রাম শুরু হবে। প্রথমে খাবার তারপর অন্য প্রোগ্রাম। এখন কিছু খেলে ওখানে আর কিছু খেতে পারবিনা। ইলিশ খিচুড়ি খাবি, পেট খালি রাখ। কিন্তু ছোট ভাই উল্টা যুক্তি দিলো। সে বললো, খান ভাই আপনারে একখান কথা কই। বাঙ্গালীর কোন প্রোগ্রাম আপনি নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হতে দেখছেন? আমি কোনদিন দেখি নাই। আমি তাকে বললাম, কিন্তু এটা প্রেসক্লাবের প্রোগ্রাম। প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের ক্লাব। সাংবাদিকরা সময়ের মূল্য বুঝে। সুতরাং প্রোগ্রাম নির্দিষ্ট সময়েই শুরু হবে। সে বললো, ৭টায় শুরু হয়ে ১০টায় যদি প্রোগ্রাম শেষ হয়, নির্দিষ্ট সময়েও যদি শুরু হয় তাহলেও খাবার দিতে দিতে  রাত  ৮টা বেজে যাবে। আর যদি অনুষ্ঠানের মাঝখানে খাবার দেয় তাহলে ৮.৩০টায় খাবার দিবে। খাবার  কখন দিবে? আমি বললাম প্রথমেই খাবার দিবে, তারপর সুর ছন্দ কবিতা।
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। সে বললো, এখন মাত্র ৬টা বাজে এতক্ষণ কি উপোস থাকবো? আমি ভয়ে ভয়ে তাকে পপ কর্ণের প্যাকেট দেখিয়ে বললাম, এটা খা। সে বললো, ‘পপচিকেন‘ খাই। আমি ভাবলাম পপকর্ণ আর পপচিকেন বোধহয় একই জিনিস তাই মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। কিন্তু বিল দেওয়ার সময় বিলটা অনেক বেশি মনে হলো। ছোট ভাইকে বললাম, পপ কর্ণের এত দাম নাকি রে? সে বললো, খান ভাই, আপনি পপ চিকেন চিনেন না? মুরগীর প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বিল দিলাম। এই যাত্রায় ভালোই খসলো।
রাস্তায় চির সবুজ সিক্স প্যাক এমাদ ভাই, জুবায়ের ভাই, রহমত ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। তাদের মুখে হাসি দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো। যাক সভাপতি, সেক্রেটারী যেহেতু আগেই আসছেন, প্রোগ্রাম তাহলে যথাসময়েই শুরু হবে। ছোট ভাইকে নিয়ে ব্রিকলেইন ঘুরে ঠিক ৭.টায় হলে ঢুকলাম। কিন্তু কোথায় কী! ইলিশের অন্তর জুড়ানো কড়া ঘ্রাণ কোথাও পাচ্ছিনা। হলের লাউন্জে জগন্নাথ হলের খাওয়া দাওয়া চলছে। তাদের খাওয়া দাওয়া দেখে পেটের ক্ষুধা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সর্বভুক ছোট ভাই প্রেসক্লাবের খিচুড়ি ইলিশ না দেখে জগন্নাথ হলের সাথে জয়েন করছে।
প্রেসক্লাবের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কোন নামই নাই ! অতিথিরা কেবল আসতে শুরু করেছেন। একজন একজন করে অতিথি আসছেন, জুবায়ের ভাই গেইট থেকে তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। যারা আগেই এসেছেন তারা গ্রুপে গ্রুপে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। নাজমুল ভাই, রুপী আপা প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এক কোণায় আনাস ভাই অন্য কোনায় কিবরিয়া ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। ইলিশ খিচুড়ি খাওয়ার সময় নিশ্চয় তারা এক লাইনে দাঁড়াবেন।

 

আহাদ ভাই ইব্রাহিম ভাই কারো কোন খোঁজই নাই। নাহাস ভাই, আনিস ভাই, মুরাদ ভাই, সাজ্জাদ ভাই, সাইম ভাই, মিল্টন ভাই, বুলবুল ভাই, মাহবুব ভাই, তানিম ভাই, ইমরান ভাই কারো কোন খবর নাই! তাহের ভাই-শিহাব ভাইকেও দেখতে পাচ্ছিনা। শাকিল ভাই পোশাক পড়েছেন নাকি পোশাকই তাকে পড়ে আছে ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা। অন্য একজনকে দেখলাম। ইলেকশনের আগে যিনি এক মাইল দুর থেকে সালাম দিছেন।  কিন্তু আজকে আমি তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম তিনি চিনেও চিনলেন না।
কাইয়ুম ভাইকে দেখলাম বসার চেয়ার ঠিক করছেন। মুকিম ভাই এসে পোশাক আশাক দেখে আমাকে হলের লোক ভেবে পার্কিং ফ্রি কিনা জিজ্ঞাসা করছেন! বাসন ভাই শাহনাজ আপার কানে কানে কি যেনো জরুরী কথা বলছেন। সময় কাটাতে মিজবাহ ভাই জানা কৌতুকই আবার বলছেন,‘ পাশের বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে। আরেক জন পাশের বাড়িতে ভাত খাচ্ছে। ইলিশ মাছের গন্ধে তার খুব খেতে ইচ্ছে করছে। ঘরে খাবারও তেমন কিছু নেই। কাচা মরিচ দিয়ে খাওয়া। অবস্থা তেমন ভাল না। বৌকে বলছে বৌ …যা ..পাশের বাড়ী থেকে আমার জন্য এক টুকরো ইলিশ মাছ চেয়ে নিয়ে আয়। বউ বললো- ছি.. ছি.. কি করে বলি…। কিন্তু একান্তই স্বামীর হুকুম; তো গিয়ে ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে।
প্লেটে এককোণে ইলিশ মাছটা রেখেছে। ইলিশ মাছটা সরিয়ে আরক কোণায় রেখেছে তো ঐ যে দাগ লাগলো যে দাগ লাগলো তা দিয়ে কিছু ভাত খেলো। আবার অন্য জায়গায় রাখলো তার পর আবার ঐ দাগ লাগা অংশ দিয়ে কিছু ভাত খেলো। বললো যা যাদের ইলিশ মাছ এনেছিস তাদের মাছ দিয়ে আয়। ঐ যে দাগ লাগলো তা দিয়ে ভাত খেয়ে ফেললো। ভাত পুরিয়ে গেলো এই হচ্ছে ইলিশ। যে মাছ পুরো খেতে হয় না। যার দাগ লাগলে ভাত খাওয়া হয়ে যায়।‘
মিসবাহ ভাই বলেই যাচ্ছেন,‘ কলকাতার এক পুরনো বাংলা ছবিতে গৃহকর্তা খেতে বসেছেন। কাছের দেয়ালে একটা ইলিশের ছবি আঁকা। তিনি একটা করে ভাতের লোকমা হাতে নিচ্ছেন আর ওই ইলিশের ছবির সঙ্গে স্পর্শ করে গলায় দিচ্ছেন। সব শেষে তৃপ্তি নিয়ে বললেন, ‘আকালের এই বাজারে ইলিশ খেতে না পারি, ইলিশের ছবির সঙ্গে ভাত ছুঁইয়ে তো খেতে পারছি।’

 

এক কোণায় বসে উর্মি আপা শুধু ইলিশের মাথা দিয়েই কিভাবে ননদ বা শ্বশুরকে বশ করা যায় সদ্য বিবাহিত মেয়েদের সেই উপদেশ দিচ্ছেন। বলছেন,‘ শাশুড়ি বৌমাকে উপদেশ দিচ্ছেন, পুঁই শাকে যদি দাও ইলিশের মাথা, ননদিনি কয় তার গুপ্ত যত কথা। যদি ইলিশের মাথা দিয়া রান্ধ কচুশাক,গোমড়া শ্বশুর আনন্দেতে হইবে সবাক।‘ তারেক ভাই চশমার নিচ দিয়ে পিট পিট করে তাকাচ্ছেন। তার মতিগতি সুবিধের মনে হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে এখনই বলবেন, ‘আসেন একটা সেলফি তুলি।‘
মুকিম ভাই গাড়ি পার্ক করে এসে বাসন ভাইয়ের সাথে জয়েন করছেন। বাসন ভাই শাহনাজ আপাকে মুকিম ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। শাহনাজ, কবি ও লেখক, টপ অব দ্যাট খুব ভালো ইলিশ রাধেন। মুকিম ভাই বাসন ভাইকে বলছেন,‘ শুনেছি, মহাবীর আলেকজান্ডার নাকি খাবারের সময় ইলিশ মাছের তেরছা কাটা গলায় আটকে মৃত্যুবরণ করেন। বাসন ভাই মুকিম ভাইকে বলছেন,‘ এটি ঐতিহাসের দিক থেকে কতটা সত্য জানিনা। কেউ বলেনি। তবে আলেকজান্ডার যদি নরকেও  যায়, অন্তত ওখানে গিয়ে এ কথাটা বলতে পারবে যে, এখানে আসার আগে প্রাণভরে ইলিশ মাছ খেয়ে এসেছি। আমার মনে আর কোনো দুঃখ নাই।’

এটা শুনে শাহনাজ আপা বলছেন,‘ গোলাপ যেমন সুন্দর, ইলিশও তেমনই সুন্দর। গাছ থেকে গোলাপ তুলতে গিয়ে কেউ যদি অসাবধান হয়, তা হলে যেমন কাঁটা লাগার সম্ভাবনা থাকে, তেমনই নিয়ম না জেনে ইলিশ খেতে গেলেও সেই একই ভাবে কাঁটা ফুটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আলেকজান্ডার খাওয়ার আগে নিশ্চয় বাংলা ভাষায় এখনও পর্যন্ত লেখা একমাত্র নির্ভরযোগ্য বই— ‘ইলিশ পুরাণ‘ পড়েন নাই।

 

আফসোস! শাহনাজ আপা আলেকজান্ডারের জন্য আফসোস করছেন আমি আফসোস করছি ইলিশ খিচুড়ির জন্য। ৭টা, ৮টা, সাড়ে ৮টা বেজে গেলো ইলিশ খিচুড়ির কোন খবর নাই। চারদিকে ইলিশের গল্প চলছে। তবারক আসলো, ভাবলাম তবারক নিশ্চয় তবারক নিয়ে আসছেন। কিন্তু না ক্যান্টিন বন্ধ দেখে তবারককেও দেখলাম মন খারাপ করে বসে আছেন। আমি এমাদ ভাই আর জুবায়ের ভাইকে খুঁজছি। ওই তো, সেকি তারা পোশাক কখন বদল করলেন! বর্ষবরণ উপলক্ষে সবাইকে কি তাহলে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে নতুন পোশাক দেয়া হচ্ছে? তাই যদি হয় তাহলে আমার পোশাক কই?
আমি পোশাকের খুঁজে ব্যাকস্টেজে গিয়ে দেখি মৃধা ভাই জন্মদিনের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে তিনি তড়িঘড়ি গায়ে একটা পাজ্ঞাবী চাপালেন। পোশাক বদল করে বললেন, ফটোসেশনের জন্য এই পোশাক তারা সাথে করেই নিয়ে আসছেন। রহমত ভাইকেও দেখলাম কোন ফাঁকে যেনো পোশাক বদল করছেন।
এনাম বাইরে থেকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞাসা করছেন, প্রোগাম শেষ হইছে। আমি এনামকে ক্যান্টিন দেখিয়ে বললাম, ‘শুরুই হই নাই?‘ এনামকে বেশ খুশি মনে হলো। ৭টায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ৮.৩০ টার দিকে মৃধা ভাই নতুন পাজ্ঞাবী পড়ে এসে অ্যানাউন্সমেন্ট করলেন,‘ একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। একটু পরে নাজমুল ভাই এসেও তাই বললেন। কিন্তু অনুষ্ঠান আর শুরু হলোনা!

চারপাশের সবাইকে দেখে মনে হল আমি ছাড়া আর কারও যেনো সময়ের অভাব নাই। কারও কোন টেনশন নাই। দেড়-দুই ঘন্টা ট্রেন লেট যেন খুবই স্বাভাবিক  ব্যাপার। প্রায় ৯টা বেজে গেলো। সর্বভুক ছোট ভাই এসে বললো, ‘চলেন যাই। ইলিশ খিচুড়ি আপনার কপালে নাই। এরা কখন খিচুড়ি পাকাবে আর কখনইবা ইলিশ ভাজবে! জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ইলিশ যেদিন কিনবা সেদিনই রান্না করবা; আর চেষ্টা করবা রান্না কইরাই খাইতে দিতে। দুইবার গরম করলে ইলিশের স্বাদ নষ্ট হয়। পদ্মার ইলিশ কিনতে চেষ্টা করবা।স্যার আরো বলেছেন, কাটার পর ইলিশ মাছ নাকি আর ধুতে হয় না। তাতে আসল স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। তিনি রক্ত-টক্ত মাছ কাটার পর সুতি কাপড় দিয়ে রক্ত ভালোভাবে মুছে নিতে বলেছেন। শ্যাডওয়েলের মাছ বাজারে আজকেই সরাসরি ফ্লাইটে পদ্মার ইলিশ আসছে। চলেন কিনে নিয়ে আপনার বাসায় যাই। মাছের মাথাডা এমুন কড়করা কইরা ভাইজ্জা দিমু বাসায় কামড় দিবেন ব্রিকলেইন থাইক্যা আওয়াজ শুনা যাইবো।‘ ছোট ভাই এমনভাবে বললো, যেনো এই মাত্র ভাজাভাজি শেষ করলো। ইলিশের গন্ধে আমার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো! হল থেকে বিরস মনে বের হলাম।

 

গেইটে লিটন ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। আমি বের হচ্ছি, লিটন ভাই তার মেয়েদের নিয়ে ঢুকছেন।  চোখে চোখে কথা হলো। আমি কি বললাম লিটন ভাই বুঝলেন। লিটন ভাই কি বললেন, আমিও ঠিক বুঝলাম। দু‘জনেই হাসলাম। নিন্দুকেরা বলে বাঙাল চিরকালই খাবারের কাঙাল। আমি বোধহয় একটু বেশিই কাঙাল। মানুষ মেলায় যায় ঘুরতে, আনন্দ করতে, একে অন্যের সাথে দেখা করতে কিন্তু আমি যাই খাবার খেতে।

 

টাওয়ার হ্যামলেটের বৈশাখী মেলায় একবার দাওয়াত করছিলো। চিংড়ি ভর্তা, আলু ভর্তা, টাকি মাছ ভর্তা, শুটকি ভর্তা আর ইলিশ ভাজা দিয়ে আধাগামলা ভাত একাই সাবাড়  করে আসছিলাম দেখে আর দাওয়াত করেনি। দ্বিতীয়বার আর ডাকেনি। আয়োজকরা ডাকার সাহস পায়নি। বর্তমানে ওজন কমাচ্ছি, ৫ কেজি কমিয়েছি আরও ৫ কেজি কমাতে হবে, ডাক্তারের কড়া নির্দেশ। কম খাওয়ার নির্দেশ। তাই সকালে ২টা পরোটা, ডিম, সব্জি ভাজি সাথে মুরগী না হয় ভেড়ার মাংসের স্যুপ, দুপুরে ৪/৫ টা রুটি দিয়ে ছোট মাছের চচ্চড়ি, রুই মাছের ঝোল, কোপ্তা কারি কিংবা গরুর মাংসের তরকারি রাতে ভাতের সাথেও  প্রায় একই ভাব চলে, এর মাঝে সন্ধ্যায় হালকা পাতলা নাস্তা করি। না খেয়ে না খেয়ে আবার শুকিয়ে যাব না তো ? এই নিয়ে দু:চিন্তায় আছি! না খেয়ে বাসায় চলে আসায় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে।
এই খুশিতে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব নিশ্চয় আগামীতেও ডাকবে। আহ! ইলিশ খিচুড়ি! আহ! আগামী বছর তোমার সাথে নিশ্চয় দেখা হবে। আহ! ইলিশ খিচুড়ি! আহ!