রাশিদা আহমেদ ন্যান্সী: ছোটবেলায় গোপাল ভাঁড়ের গল্প পড়তাম অনেক আনন্দ নিয়ে।কারণ গোপাল ভাঁড়ের গল্পে আনন্দের পাশাপাশি একটা মেসেজ থাকত।অনেক সময় সেটা ছিল শিক্ষনীয়ও বটে।তো একটা গল্প পড়েছিলাম এরকম ….”একদিন রাজা মশাই সভাসদদের কাছে জানতে চাইলেন যে,উনার রাজ্যে কোন পেশার লোক সবচেয়ে বেশী? প্রমাণসহ দেখাতে হবে।রাজ সভার মন্ত্রী,উজির,নাজির,কোতোয়াল সবাই যার যার মতামত রাখলেন।কেউ বললেন,কামার,কুমোর,কেউবা বললেন,নাপিত,ধোপা ইত্যাদি।কিন্তু তাদের মতামতের স্বপক্ষে কোন প্রমাগ দিতে পারলেন না।সেই সময় গোপাল ভাঁড়ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন (উল্লেখ্য গোপাল ভাঁড় ছিলেন রাজার সভাসদদের একজন)।একমাত্র গোপালই বললেন যে,আপনার রাজ্যে চিকিৎসক পেশার লোক বেশী অর্থাৎ ডাক্তারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।রাজা বললেন,প্রমাণ চাই?গোপাল বললেন,আগামীকালই আপনি প্রমাণ পাবেন।
সভার কাজ শেষে সবাই চলে গেলেন কিন্তু গোপাল থেকে গেলেন।গোপাল রাজাকে বললেন, রাজামশাই বেয়াদবি না নিলে আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।রাজা অভয় দিতেই গোপাল বললেন,আগামী কাল আপনি যখন রাজসভায় আসবেন তখন দয়া করে যদি একটু অসুস্থতার ভান করতেন তাহলে আমার প্রমাণ যোগাড় করতে বেশী বেগ পেতে হতো না। রাজা বললেন,ঠিক আছে।পরদিন রাজা যখন সভার উদ্দেশে রওনা হলেন,পথিমধ্যে অনেকেই অসুস্থ রাজাকে সুস্থ হওয়ার জন্য নানাপ্রকার টোটকা দিলেন। রাজা শুধু শুনলেন আর মুচকি হাসলেন। সভায় উপস্থিত হওয়ার পর রাজাকে অসুস্থ দেখে সাথে সাথেই সভায় উপস্থিত
মন্ত্রী,উজির,নাজির,কোতোয়াল,সেনাপতি কেউ বাদ পড়লেন না রাজাকে পরামর্শ দিতে। কেউ বললেন হুজুর এটা খেলে ভাল হবে,কেউ বললেন ওটা খেলে আরো দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।আর এই সুযোগে গোপাল রাজা মশাইকে বললেন, কি রাজা মশাই এখন তো বুঝতে পারছেন আপনার রাজ্যে চিকিৎসক অর্থাৎ ডাক্তারের সংখ্যাই বেশী।প্রমাণ পেলেন তো?ততক্ষণে কিন্তু রাজা মশাইও গোপালের অভিসন্ধি বুঝে গেছেন।গোপালের বুদ্ধিমত্তায় রাজা মশাইকে মানতেই হলো যে তার রাজ্যে ডাক্তারের সংখ্যাই বেশী.
এই গল্পের অবতারণা এই জন্যই যে,করোনা ভাইরাসে এখন সারা বিশ্ব বিপর্যয়ের মূখে।বাংলাদেশও এই বিপর্যয়ের বাইরে নয়।দিন দিন এর প্রাদুর্ভাবে জীবন ও জীবিকা সংকটাপন্ন।সারা বিশ্বের অর্থনীতি আজ বিধ্বস্ত।এই সংকট কাটিয়ে উঠতে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নাভিশ্বাস উঠবে।অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যতটুকু স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা উচিত তার অনেকটাই আমরা পালন করতে পারছি না বিধায় নানা অজুহাতে বাইরে বের হচ্ছি।সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারছি না।এত বুঝেও অবুঝের মতো চলছি।চোখ,কান খোলা রেখে ও জেগে জেগে ঘুমাচ্ছি।আর সেই সুযোগে করোনা তার করাল থাবা বসাচ্ছে যার দরুন আমাদের ছাতক উপজেলা এখন আর নিরাপদ নয় বাতাসে করোনা ঘুরে বেড়াচ্ছে।প্রথমে একজন,পরেরদিন আরেকজন,এভাবে আরও কতজন যে আক্রান্ত হবে এই ছোঁয়াছে রোগের দ্বারা তার হদিস আল্লাহ্ ছাড়া কারো জানা নেই।অথচ গণ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া অপেন করলেই দেখা যায় এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা,পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা ও ঘরে থাকার পরামর্শ,সাথে কি কি খেলে এই ভাইরাস নির্মূল হবে তার পোস্ট দিয়ে শেয়ারের হুল্লোড়।তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো গোপাল ভাঁড়ের এই গল্পের কথা।
আমাদের বাংলাদেশেও এখন ডাক্তারের সংখ্যা অনেক বেশী।এখন কমবেশী সবাই আমরা ডাক্তার।কেউ আর রোগী নই!রোগী না হতে চাইলে আমাদের যে স্বাস্হ্যবিধি জানা আছে তাতো মানতে হবে, না শুধু ডাক্তারী ফলালেই হবে?এখন ডাক্তারীর পাশাপাশি আমরা ঈমান,আমলের দিক থেকেও এগিয়ে আছি।অথচ আল্লাহ্ র গজব এই করোনা ভাইরাস,মানছি কিন্তু তাও আমাদের ফিৎনা,ফ্যাসাদ, চুরি, ডাকাতি,বিশেষ করে গরীবের হক চুরি থেকেও পিছপা হচ্ছি না।মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি অথচ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে চলছে চালচুরি থেকে হত্যা,ধর্ষণ এর মত নির্লজ্জ আর অমানবিক কর্মকান্ড।করোনার কারণে দুনিয়ায় এখন চলছে কেয়ামতের মহড়া তবু মানুষের হুঁশ হচ্ছে না! সন্তান পিতা-মাতার কাছে,পিতামাতা সন্তানের কাছে,স্বামী-স্ত্রী,ভাই-বোন,আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব কেউ কারো নয়।সবাই অচেনা হয়ে যাচ্ছে।আজ এক মাসের উপরে এত কাছে থেকেও আমার অসুস্থ মাকে গিয়ে দেখতে পারছি না।মাকে না দেখে থাকার কষ্ট শুধু সন্তান্ই জানে আর সন্তানকে না দেখলে মায়ের যে কষ্ট তা শুধু মা ই জানেন মনে হয় এত কষ্ট এই জীবনে আর কখনো পাইনি ভয়াবহ করোনা(কোভিড-১৯) ভাইরাসে মৃত মানুষকে শেষ বিদায়ের দেখাটুকু পর্যন্ত করতে দিচ্ছেনা। কিন্তু আমরা অবিচল…প্রশাসনের কঠোর নজরদারি আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকারের সমস্ত প্রণোদনায় পানি ঢেলে চলছে আমাদের অবাধ বিচরণ।নির্বিঘ্ল চলাফেরা আর জরুরী প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে চলছে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ানো! এ তো ঘুরে বেড়ানো নয়,মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা কিংবা জেনে শুনে বিষ পান করার মতোই।
অথচ আমাদের সচেতন করার জন্য নিরাপদ রাখার জন্য,আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য এদেশের সরকার তথা প্রশাসন,পুলিশ,সেনাবাহিনী,র্র্য্যব,ডাক্তার,নার্স সহ মাঠ পর্যায়ে স্বেচছাসেবকদের মতো অনেক সোনার ছেলেমেয়েরা নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন(তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্যালুট জানাই)।তবুও কেন আমরা সচেতন হচ্ছি না?আর কবে আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে?লাশের মিছিলে আর কত লাশ জড়ো হলে,আর কত মায়ের বুক খালি হলে,আর কত মঈন উদ্দিনকে নিজের সন্তানদের এতিম করে আত্মাহুতি দিলে আমরা ক্ষান্ত হবো?তাই দয়া করে ঘরে থাকুন,নিরাপদ থাকুন….বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে নিয়মটাই যেন অনিয়মে পর্যবসিত!
সুতরাং আল্লাহ্ ই ভরসা।একমাত্র আল্লাহ্ ই পারেন আমাদের এই গজব থেকে রক্ষা করতে।ইয়া আল্লাহ্,পবিত্র মাস রমজানের উসিলায় আপনার গুণাহগার বান্দাদেরকে রহম করুন।আপনার বান্দার গুণাহ্ যদি হয় পাহাড় সমান,আপনার ক্ষমা তো আকাশচুম্বি।আমাদের এই গজব থেকে হেফাজত করুন।আমরা আপনার দরবারে অবনত মস্তকে ক্ষমা প্রার্থী।আমাদের ক্ষমা করুন মালিক।