ফাহমিদা ইয়াসমিন: নারী শব্দটির মাঝেই যেন আটকে পড়ে আছে নারী। মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যা এসবই নারীর বাস্তব পরিচয়। এর বাইরে আরো হয়তো পরিচয় মেলে নারীর তা আরো হতাশাব্যঞ্জক। যেমন: পরনারী, পতিতা প্রভৃতি। অথচ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, কোনো যুগে একা হয়নি কোন জয়ী পুরুষের তরবারী…..।
বলা হয় ‘নারী মায়ের জাত’। আসলেই কি তাই? আমার কাছে তা মোটেও মনে হয় না। কারণ নারী এখনো নিজের সক্রিয় জাতে পৌঁছাতে পারেনি। কেননা, বিশ্বায়নের প্রভাবে এখন নারীরা ঘর থেকে বাহির হতে শিখেছে মাত্র। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পোশাক শিল্প নারীদের দখলে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু মাস শেষে দেখা যায় নারীদের আয়ের টাকা সেই পুরুষের দখলে। অফিসে দেখা যায়, বসদের, সহকর্মীদের মনোরঞ্জন করতে বাধ্য হতে হয় নারীদের। নইলে কপালে জোটে অসহনীয় যন্ত্রণা। এসব থেকে বের হতে আরো সময় লাগবে।
নারী বিষয়ে নারীর চারিত্রিক বিচার করার সম্মতি দেয়া হয়েছে তার কথার ভঙ্গি, পোশাকের ব্যবহার, বিপরীতে দেখা যায় পুরুষরা এখনো পশুর মতো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে। তাতে সমাজের মান যায় না। আমি বলছি না নারীকে পুরুষের মতো হতে। কিন্তু নারী কেন নারী শব্দের শোষণে পিষ্ট থাকবে। তার জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধার কোনো প্রয়োজন হয় না এই বৈচারিক কাজে। সর্বোপরি নারীকে বিচার করতে হবে যৌন অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। নারী যতদিন যৌনতার পাঁচিল টপকায়নি, কোনো পুরুষের সাথে কথা বলেনি, একসাথে বসে হাসেনি, ততদিন সে সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোক, এমন ধারণা সমাজের কলিজার বসে আছে। যেকোনো পুরুষ তাকে সম্মান দিয়ে আইন আর নিয়মনীতির সর্বোচ্চ প্রভাব খাটিয়ে সিদ্ধ করে ঘরের পরিচারিকা নিয়োগ করতে আগ্রহী হয়।
বাসে কেন নারীদের জন্য সিট বরাদ্দ থাকবে। তাও দেখা যায় ইঞ্জিনের পাশেই। এসবের মূল কারণ বাঙালি নারীরা এখনো নারী থাকতেই পছন্দ করে। জন্মের পর তাই তো বাঙালি মেয়ে শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হয় পুতুল, হাড়ি-পাতিল নিয়ে খেলতে। অথচ, এর বিপরীত হলেও কোনো দোষের ছিল না। তাই নারী বা পুরুষ নয়, মূলত পরির্তন করতে হবে সমাজের ধ্যান-ধারণাকে। চিন্তা করতে হবে নারীরা আর কোনো একক শব্দ নয়। এখন প্রায় দেশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়েও নারীদের দেখতে পাওয়া যায়। যদিও সংখ্যায় নগণ্য। সেই নগণ্যকে উদাহরণ ভেবে নারীদের সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে পরিবারের সবার আগ্রহ থাকতে হবে এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে নারী-পুরুষের সমতা আনতে। এই সমতা যেন আবার সমাজের ক্ষতির কারণ না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে।
নিজের অধিকার সম্পর্কে নারীকেই প্রথম সচেতন হতে হবে। নইলে কখনোই নিজেদের সম্পর্কে নিজেরাই অজানা থেকে যাবে। যদিও এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের রয়েছে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা। এখানেই আমরা দেখি ঐতিহাসিকভাবে একটি লড়াই চলে আসছে নারী একজন ব্যক্তি কি না? পূর্ণ মানব সন্তান কি না? তার অধিকার কতটুকু আছে, কিভাবে বা আছে, এসব বিষয়ে তর্কবির্তক। এভাবে সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে একটি বিশেষ সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে একটি বৈষম্যের সংস্কৃতি করা হয়। যাকে আমরা বলি পুরুষতান্ত্রিকতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষ-নারী উভয়ের মাঝেই থাকতে পারে। এ উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা আসি এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। এখানে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা সমাজ-মানসে গ্রোথিত আছে । সে জন্যই নারীর অগ্রযাত্রা, নারীর সক্রিয় দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং অনেক ক্ষেত্রে সাফল্যের কথা শুনলেও বিপরীত চোখে পড়ে।
পরিসংখ্যান দেখে নয়, বরং নারীদের নিজেদের নিজেরাই চিনতে হবে। জানতে হবে এই সমাজে নারী যা পারে তা পুরুষও পারে। আবার পুরুষ যা পারে তা নারীরাও পারে। যেহেতু কর্মের ক্ষেত্রে উভয়েই সমান, তাই নিজেদের আরো মেলে ধরতে হবে, বেগবান হতে হবে নিজেদের চিনতে ও চেনাতে। নারীরা কর্মে না মানসকিতায় বন্দী। এই বন্দিত্ব যতটুকু সমাজের দেয়া তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক তা গ্রহণ করে নারী সেজে থাকা। নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে এটি একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায়।