প্রচ্ছদ জানা-অজানা সর্বকালের সেরা সঙ্গীত স্রষ্টা

সর্বকালের সেরা সঙ্গীত স্রষ্টা

0
ছবি : সংগৃহীত
১৮২৪ সালের ৭ মে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার ইম্পেরিয়াল অ্যান্ড রয়্যাল কোর্ট থিয়েটারে জড়ো হয়েছিলেন দেশের রাজপরিবারের সদস্য, অভিজাতবর্গ ও নগরীর সাংস্কৃতিক জগতের নামকরা লোকজন। এক অসাধারণ অনুষ্ঠান দেখতে তারা জড়ো হয়েছিলেন। লুডভিগ ফন বেটোফেনের ‘নাইনথ সিম্ফোনি’ প্রথমবারের মতো সেখানে বাজানো হবে।
ভিয়েনায় ওই দিন যে অর্কেস্ট্রা সাজানো হয়েছে, তখনো পর্যন্ত বিশ্বে সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় অর্কেস্ট্রা। এরকম কনসার্টও এর আগে বিশ্ব কখনো দেখেনি। আর এই প্রথম কোনো অর্কেস্ট্রার আয়োজনে পরিবর্তন এনে সেখানে যন্ত্রের পাশাপাশি মানুষের কণ্ঠ যুক্ত করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বেটোফেন মঞ্চে উঠলেন। তিনি দর্শকদের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন এবং আবেগ ভরে তার সঙ্গীত দলকে পরিচালনা করতে শুরু করলেন। তিনি তার শরীর ঝাঁকিয়ে ও হাত নেড়ে সঙ্গীত পরিচালনা করছিলেন। নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় তিনি এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, যখন সুর থেমে যায় তখনো তিনি তার শরীর আন্দোলিত করে যাচ্ছিলেন।
তাকে থামাতে একপর্যায়ে তার অর্কেস্ট্রা দলের একজন বাদক এগিয়ে এলেন তার দিকে। বেটোফেনকে ঘুরিয়ে দর্শকদের দিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। যাতে তিনি দেখতে পান দর্শকরা তুমুল করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
কিন্তু ওই করতালির কিছুই তিনি শুনতে পারছিলেন না। কারণ অসাধারণ সুরস্রষ্টা বেটোফেন ততদিনে একেবারে বধির হয়ে গেছেন। বধির হওয়ার পরও বিশ্বের সর্বকালের সেরা কিছু সঙ্গীত সৃষ্টি করে গেছেন তিনি।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতের অধ্যাপক ও বেটোফেনকে নিয়ে লেখা এক জীবনীগ্রন্থের লেখক প্রফেসর লরা টানব্রিজ বলেন, এই ঘটনার তিন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়।
‘নাইনথ সিম্ফোনি যেদিন প্রথমবারের মতো বাজানো হয়, সেদিন তিনি মঞ্চে ছিলেন। তবে তার পাশেই একজন সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন, যিনি সবকিছু সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করছিলেন। কারণ ততদিনে এটি জানা হয়ে গেছে যে বেটোফেন আর কনডাক্টর বা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মোটেও নির্ভরযোগ্য নন,’ বলছিলেন প্রফেসর টানব্রিজ।
‘সেই সন্ধ্যাটি খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হতে পারতো। কারণ যিনি সঙ্গীত পরিচালক এবং সঙ্গীত স্রষ্টা তিনি বধির। আর যে সঙ্গীতটি তিনি রচনা করেছেন, সেটিও অস্বাভাবিক রকমের দীর্ঘ ও জটিল। আর সেসময় সচরাচর যেটি ঘটতো এরকম একটা বড় অনুষ্ঠানের আগে যুক্ত সঙ্গীতবাদকরা রিহার্সেল করার খুব কম সুযোগ পেতেন। কিন্তু কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যে সবকিছু শেষপর্যন্ত ঠিকঠাকভাবে শেষে হয়েছিল, সেটা আসলেই অবাক করার মতো’, বলছিলেন প্রফেসর টানব্রিজ।
বেটোফেনকে নিয়ে লরা টানব্রিজের জীবনীগ্রন্থ
বেটোফেনের তার জন্ম ২৫০ বছর আগে জার্মানির বন শহরে। যদিও তার সঠিক জন্ম তারিখ নিয়ে একটু সংশয় আছে। কেউ বলেন এটি ১৬ ডিসেম্বর। তবে এমন রেকর্ড আছে, যাতে দেখা যায়, ১৭৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর খ্রীস্টধর্ম অনুযায়ী তার জন্মের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
তিনি ছিলেন এমন একজন সঙ্গীতজ্ঞ। যিনি কল্পনাশক্তি, আবেগ ও ক্ষমতার অধিকারী। একই সাথে তার ব্যক্তিত্ব ছিল খুব জটিল ও বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বের এক সংমিশ্রন।
তিনি ইউরোপে নেপোলিয়ন যুগের যুদ্ধের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। পুরো ইউরোপ জুড়ে তখন মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিরতা।
যদিও তিনি জার্মান বংশোদ্ভূত, তাকে ভিয়েনার সবচাইতে মহৎ সঙ্গীত স্রষ্টাদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভিয়েনায় এরকম স্বীকৃতি পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কারণ তখন ভিয়েনার আছে গর্ব করার মতো সব সঙ্গীতজ্ঞ ওলফগ্যাং আমাডিউস মোৎজার্ট, ইউসেফ হাইডেন, ফ্রান্টস শুবার্ট অথবা আন্তনিও ভিভালডির মতো সর্বকালের বিশ্বখ্যাত সবাই কম্পোজার।
প্রফেসর টানব্রিজের মতে, ‘অনেকভাবে দেখতে গেলে বেটোফেন আসলে শব্দ এবং এর মাত্রার বিবেচনায় সঙ্গীতকে বৈপ্লবিকভাবে পাল্টে দিয়েছিলেন।
সঙ্গীত যে মানুষের ভাবনা এবং অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারে এটি তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সঙ্গীত কেবল বিশুদ্ধ বিনোদন নয়, এটি তার চাইতে গভীরতর কিছু।’
তিনি বলেন, ‘আসলে সঙ্গীতকে শিল্পের পর্যায়ে নিতে মৌলিক অবদান রাখেন বেটোফেন।’
তবে একইসঙ্গে অবশ্য তখন বেটোফেনের অনেক দুর্নাম ছিল। তিনি ছিলেন বদমেজাজী, স্বার্থপর। তিনি ছিলেন আত্মপ্রেমে ভোগা মানুষ, অসামাজিক ও তার ব্যবহার ছিল জঘন্য। প্রেমে ব্যর্থতার কারণে তিনি ছিলেন হতাশাগ্রস্ত, তার জীবনযাপন ছিল উচ্ছৃঙ্খল। তিনি তীব্রভাবে মদপানে আসক্ত ছিলেন।
‘তবে এগুলো আসলে বেটোফেনকে ঘিরে যে রোমান্টিক মিথ, তারও অংশ‍’, বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।
বেটোফেনকে এমন এক মহান সঙ্গীতজ্ঞ বলে গণ্য করা হয় যিনি যার সবকিছু ছেড়ে কেবল সঙ্গীতের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। যিনি এমন সব সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন যা আমাদের কল্পনা সীমার বাইরে। বেটোফেন যেন আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরের কোনো জগত থেকে আসা মানুষ।
তিনি অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। আর তাকে চিকিৎসার নামে অনেক যন্ত্রণা আর অপচিকিৎসার শিকার হতে হয়েছিল, যার ফলে তার স্বাস্থ্য আরো ভেঙে পড়েছিল।
বেটোফেনের ব্যাপারে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ফরেনসিক তদন্ত সাম্প্রতিককালে হয়েছে। এগুলোর লক্ষ্য ছিল তিনি আসলে কী ধরনের অসুস্থতায় ভুগেছেন, পরে তার বধির হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলোর কি প্রভাব ছিল এবং কীভাবে তার ব্যক্তিত্ব এবং সঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে এগুলোর প্রভাব পড়েছে তা জানা।
বেটোফেনের যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল, আজকের দিনে চিকি‍ৎসকরা সেগুলো কিভাবে নির্ণয় করতেন, তার একটি তালিকা তৈরি করেছেন ব্রিটিশ নিউরো-সার্জন হেনরি মার্শ।
বিবিসির জন্য বেটোফেনকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন তিনি। তার মতে, বেটোফেন মলাশয়ের প্রদাহে ভুগছিলেন। তার ছিল ইরিটেবল বোওল সিনড্রোম (আইবিএস)। সেই সাথে মারাত্মক ডায়রিয়া। তিনি একই সাথে হুইপলস রোগ, বিষন্নতা, সীসার বিষক্রিয়া ও হাইপোকন্ড্রিয়াতেও ভুগছিলেন।
বেটোফেন মারা যান ১৮২৭ সালের সালের ২৭ মার্চ। মৃত্যুর পর দিন ওই সময়ের নামকরা চিকিৎসক ইয়োহানেস ওয়াগনার তার লাশের একটি ময়নাতদন্ত করেন। তিনি দেখেন বেটোফেনের তলপেট ছিল বেশ ফাঁপা। তার লিভার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এটি সংকুচিত হয়ে স্বাভাবিক আকারের চারভাগের একভাগ হয়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায় ব্যাপক মদ্যপানের কারণে তিনি লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। মারা যাওয়ার পরদিন বেটোফেনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়।
বেটোফেন নিয়মিত ঘরে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে ওয়াইন খেতেন। এটি ওই সময় একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কারণ তখন পানি ছিল পানের অযোগ্য, বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।
ইউনিভার্সিটি অফ স্যান হোসের বেটোফেন স্টাডিজের একজন গবেষক উইলিয়াম মেরেডিথ গবেষণা করে ওয়াইন পান করার সাথে সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন।
তিনি বেটোফেনের চুলের একটি নমুনা নিয়ে সেটির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেছেন ও দেখেছেন সেখানে সীসা আছে।
সেই যুগে যারা ওয়াইন প্রস্তুত করতো, তারা যেসব ব্যারেল বা পিপের ভেতরে আঙুরের রস জারিত করতো, সেসব পিপের ভেতরের গাত্রে সীসার প্রলেপ দিয়ে রাখতো। এর উদ্দেশ্য ছিল মদে যাতে কিছুটা মিষ্টি এবং সিরাপের মতো স্বাদ হয়। কিন্তু এই মদ যারা পান করছিল, এর ফলে যে তাদের ক্ষতি হচ্ছিল, সেটা তারা জানতো না। বধির হয়ে যাওয়ার পরও অসাধারণ সব সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন বেটোফেন।
তার শ্রবণশক্তি যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ডক্টর ওয়াগনার ময়নাতদন্তের সময় তা দেখেছেন এবং পরে তা জানিয়েছেনও।
উইলিয়াম মেরেডিথ বলেন, তার বধিরতার সমস্যা হয়তো তার পাচকতন্ত্রের অসুস্থতার সাথে সম্পর্কিত ছিল। কারণ এই দু’টি সমস্যা একসাথে দেখা দিয়েছিল। এর পাশাপাশি বেটোফেন সব সময় জ্বর ও মাথাব্যাথার অভিযোগ করতেন। বাকি জীবন ধরে তিনি ওই দুটি সমস্যায় ভুগেছেন‍।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের স্কুল অব মেডিসিনের ডা: ফিলিপ ম্যাকুইয়াক আরেকটি তত্ত্বে বলেন, এটা হয়তো কনজেনিটাল সিফিলিসের একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। এই রোগটি এসেছিল আমেরিকা মহাদেশ থেকে। এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে যায় ও মানুষের ব্যাপক মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ডা: ম্যাকুইয়াক বলেন, বেটোফেনের বেলায় এই রোগটি তার গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টাইনাল সমস্যা ও বধিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে নিউরো-সার্জন হেনরি মার্শের বিশ্বাস, এর কোনো প্রমাণ এখনো নেই। এগুলো কেবলই জল্পনা মাত্র।
বধির হওয়ার যন্ত্রণা
অসুস্থ হওয়ার পর একটি নিরিবিলি শহরের বাড়িতে থাকতেন তিনি।
তবে যেটা নিশ্চিতভাবে জানা যায় তা হলো, বেটোফেনের শ্রবণশক্তির সমস্যা শুরু হয় ১৭৯৭ ও ১৭৯৮ সালের মাঝে।
ডাক্তারের পরামর্শ মতো ১৮০২ সালে বেটোফেন ভিয়েনা ছেড়ে কাছের একটি শান্ত নির্জন শহর হেইলিজেনস্ট্যডটে চলে যান। সেখানে তিনি তার অসুস্থতার সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন।
এখানে বসে তিনি তার ভাইদের কাছে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিটি হেইলিজেনস্ট্যডটের প্রমাণ বলে পরিচিত। চিঠিতে তিনি তার আত্মহত্যার চিন্তা ভাবনা এবং অন্য লোককে কেন এড়িয়ে যেতে চান, সেসব বিষয়ে লেখেন।
চিঠিতে তিনি তার যন্ত্রণার কথা খুলে প্রকাশ করেন। তিনি আরো লিখেছিলেন, কিভাবে বধিরতা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার অস্থির এলোমেলো আচরণের পেছনে যে এটাই কারণ, সেকথাও লেখেন তিনি। তবে শ্রবণশক্তি হারানোর বেদনা নিয়েও তিনি বেঁচে থাকতে ও তার সঙ্গীতের সাধনা চালিয়ে যেতে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ভাইদের কাছে লেখা এই চিঠিটি তার পাঠানো হয়নি কোনোদিন। তবে মৃত্যুর পর তার কাগজপত্রের মধ্যে এটি খুঁজে পাওয়া যায়।
শ্রবণশক্তি হারানো শুরুর পর প্রথমদিকে বেটোফেন কেবল কিছু কিছু ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শুনতে পেতেন না। কিন্তু ক্রমে তিনি তার পুরো শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
‘এমন অনেক রিপোর্ট আছে যেখানে বলা হচ্ছে, তিনি বধির ও জোরে চিৎকার করে কথা বলতেন‍’, বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ। ১৮১৮ সাল নাগাদ তিনি আর কারো কথা মোটেই বুঝতে পারছিলেন না। সুতরাং তিনি লোকজনকে অনুরোধ করতেন হাতে লিখে তাকে প্রশ্ন করতে এবং কথা বলতে।
তার শেষ জীবনের দিকের কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে, যেখানে বলা হচ্ছে, তখনো তিনি হয়তো কিছু কিছু শব্দ শুনতে পেতেন। তবে খুব অস্পষ্টভাবে।
কম্পনের মাধ্যমে সঙ্গীতের সাধনা
শ্রবণশক্তি হারানোর বেদনা নিয়ে বেটোফেন ক্রমাগত নতুন নতুন সঙ্গীত সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন। এই সময়টাতে তিনি তার সবচাইতে ভাবপ্রবণ, মর্মস্পর্শী ও পরীক্ষামূলক কিছু সঙ্গীত সৃষ্টি করেন।
বিটোফেনের সবচাইতে বেশি দক্ষতা ছিল পিয়ানোতে। তিনি এই পিয়ানো বাজিয়ে তার সঙ্গীত সৃষ্টি করতেন। তিনি নানা ধরনের যন্ত্র যুক্ত করে তার পিয়ানোর শব্দ অনেকগুণ বাড়াতে পেরেছিলেন। মূলত বেটোফেনের কাছে তার মস্তিষ্কই ছিল সবচাইতে শক্তিশালী যন্ত্র।
প্রফেসর টানব্রিজ বলেন, ‘আপনাকে মনে রাখতে হবে যে যারা সঙ্গীত তৈরি করেন, তাদেরকে নিজের কল্পনাশক্তির ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হয়। তারা কিন্তু তাদের মাথার ভেতরে শব্দ শুনতে পান। বেটোফেন কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকে তার মাথার ভেতরে এরকম সঙ্গীত তৈরি করে যাচ্ছিলেন।’
‘তিনি হয়তো বাইরের বিশ্বের শব্দ শুনতে পেতেন না। কিন্তু এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে তিনি তার মনের ভেতর সঙ্গীত শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন, অথবা তার সঙ্গীত সৃষ্টির যে মেধা সেটা কমে গিয়েছিল।’
ক্ষমতা ও উচ্ছ্বাস
যে সঙ্গীত তিনি তৈরি করছেন, ওই সঙ্গীত যে তিনি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছেন না, এটি ছিল তার জন্য হতাশার। কিন্তু এর মধ্যেই বেটোফেন নতুন চ্যালেঞ্জ নিলেন। তিনি তার সঙ্গীতে এমন ধরণের শক্তি আর ভাবনা সঞ্চারিত করলেন, যেটা এর আগে কেউ কখনো দেখেনি।
বেটোফেনের সঙ্গীত বিশ্লেষণ করে সাম্প্রতিককালে কয়েকজন বলছেন, বধির হওয়ার পর তার সঙ্গীত সৃষ্টির প্রতিভা যেন আরো অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।
একজন ব্রিটিশ সঙ্গীতস্রষ্টা রিচার্ড আইরেস বলেন, ‘আপনি যদি ঠিকমত শুনতে না পারেন, তখন আপনি আপনার সঙ্গীত প্রকাশের জন্য অন্য মিউজিশিয়ানদের শক্তির ওপর নির্ভর করেন।’
রিচার্ড আইরেস নিজেও বধির। নিজের শ্রবণশক্তি হারানোর পর তিনি বেটোফেনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ওই মহান সঙ্গীতস্রষ্টা শ্রবণশক্তি হারানোর পর আরো উচ্ছ্বাসপূর্ণ সঙ্গীত তৈরিতে ঝুঁকে পড়েন।
বেটোফেনের সঙ্গীতের মধ্যে এক ধরণের স্পন্দন তৈরি হতো। বিশেষ করে তার একেবারে শেষের দিকে তৈরি করা সঙ্গীতে বৈশিষ্ট্য বেশ স্পষ্ট।
যেমন তার ‘হেইলিগার ডাংকগেসাং’ খুবই মন ভালো করে দেয়ার মতো একটি সুর। এটি তিনি সৃষ্টি করেন তার অসুস্থতা থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করার জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা হিসেবে।
মানবতা ও আশাবাদ
‘এ রকম অনেক প্রমাণ আছে যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তিনি বেশ অসামাজিক ও অসুস্থ‌ ছিলেন’, বললেন প্রফেসর টানব্রিজ। ‘কিন্তু বেটোফেন আসলে ছিলেন অনেক বিরাট এক মানুষ।’
‘তার চরিত্রের আরেকটি দিক হলো তিনি ছিলেন বন্ধু সুলভ ও আমুদে স্বভাবের। এমন অনেক উদহারণ আছে যেগুলো তার এই মানবিক দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করে’, বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।
বেটোফেন তার ‘অড টু জয়’ সঙ্গীতটি তৈরি করেন জীবনের খুবই সঙ্কটময় এক মূহূর্তে। এ থেকে বোঝা যায়, সঙ্কটের মধ্যেও তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা ছেড়ে দেননি। প্রফেসর টানব্রিজ বলেন, তার পরবর্তী কাজগুলোতেও ওই অনুভূতির প্রকাশ দেখা গেছে।
প্রফেসর টানব্রিজ আরো বলেন, ‘‘খুব অল্প বয়স থেকেই বেটোফেন ফ্রেডরিক শিলারের ‘অড টু জয়’ কবিতাটিকে সঙ্গীতে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার ‘নাইনথ সিম্ফনিতে’ এটি অন্তর্ভুক্ত করার উপায় খুঁজে পান। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এই আশা ধরে রেখেছিলেন এবং এই বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।’’
সূত্র : বিবিসি