প্রচ্ছদ জানা-অজানা পুলিৎজার প্রাইজ এবং হলুদ সাংবাদিকতা 

পুলিৎজার প্রাইজ এবং হলুদ সাংবাদিকতা 

0
সচেতন পাঠকরা নিশ্চয় পুলিৎজার প্রাইজের কথা শুনেছেন । যারা শুনেছেন তারা আশা করি জানেন এই পুরস্কারটি জোসেফ পুলিৎজার এর সম্মানে প্রদত্ত । যাকে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ডাকা হয় “গ্র্যান্ডফাদার অব দ্য জার্নালিস্ট”।

তবে সে কথায় পরে আসি । শুরু করা দরকার তার শৈশব নিয়ে – যথারীতি গ্রেট মানুষের জীবন ভাবে যেভাবে শুরু হয় তারটাও তেমনই । এক গরীব ইহুদি হাঙ্গেরিয়ান পরিবারে তার জন্ম ১০ এপ্রিল, ১৮৪৭ সালে ।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হবার আগে তার বাবার হঠাৎই বোধদয় হলো এই নতুন পৃথিবীতে বোধ হয় বেটার একটি জীবন কাটাতে পারবেন । এই লক্ষ্যে ১৮৬৪ সালে অভিবাসিত
হয়ে আমেরিকায় চলে আসেন । তখনই জোসেফ পুলিৎজারের সাংবাদিকতা বা সংবাদের সাথে প্রথম পরিচয় হয় আর তা একজন “পেপার বয়” হিসেবে (রাস্তায় ফেরি করা পেপার বিক্রেতা) ।

যা তাকে পরবর্তী জীবনের মূল্যবান কিছু শিক্ষা দেয় । তার উন্নতির সূচনা হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধে ফার্স্ট নিউইয়র্ক ক্যাভার্লিতে সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করা থেকে । এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৬৭ সালে তিনি দ্রুত আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন এবং রাজনীতিতে যোগদান করেন । কেবল তাই নয় বিলিভ ইট অরনট ১৮৭২ সালে তিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে লিবারেল রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে হোরেস গ্রীলে হতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন !!!
.
সে যাইহোক, উনি হেরে যান । এই হার তার জীবনকে একটি ভিন্ন মোড় দেয় উনি রাজনীতি থেকে মন সরিয়ে সংসার ও সাংবাদিকতায় মনযোগ দেন । তার সাথে পরিচয় হয় ক্যাথরিন কেট ডেভিস নামের মিসিসিপির এক সম্পদশালী পরিবারের নারীর সাথে । দ্রুতই ক্যাথরিন তাঁকে বিয়ে করেন । ক্যাথরিন ছিলেন তারচেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন । ঋণগ্রস্থ পুলিজিৎ তাকে সম্পদের জন্য বিয়ে করেছিলেন নাকি ভালোবেসে বিয়ে করেছেন এই প্রশ্ন আমি আপতত তুলছি না wink emoticon । পরবতীতে উনি সাত সন্তানর জনক হয়ে ছিলেন । রাফ্ল পুলিৎজার, দ্বিতীয় জোসেফ, কন্সট্যাস, এডিথ ও লুসিলির নাম জানা যায় । ৩১ ডিসেম্বর, ১৮৯৭ সালে তাদের জ্যেষ্ঠা কন্যা লুসিলি পুলিৎজার টাইফয়েড জ্বরে মারা যায়।

১৮৮৩ সালে পুলিৎজার ৩,৪৬,০০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে “নিউইয়র্ক
ওয়ার্ল্ড “করেন । যে পত্রিকাটি বছরে গড়ে চল্লিশ হাজার ডলার লোকসান দিতো । প্রচার সংখ্যা বাড়াতে পুলিৎজার মানবধর্মী কৌতুলহলোদ্দীপক গল্প, রটনা এবং
আবেগধর্মী বিষয়াবলী অন্তর্ভূক্ত করেন । যা পত্রিকাটিকে লাভের মুখ দেখায়। এবং সংবাদপত্রের নতুন ধারার প্রবর্তন করেন ।

অনুসন্ধানী ও সৃজনশীল সাংবাদিকতার প্রতিভার পরিচয় দিয়ে তিনি পুরো সাংবাদিকতার জগতে কিংবদন্তিতে পরিণত হন । আর তখনই উদয় হয় পুলিৎজারের জীবনে এক প্রেতাত্মা। নাম “উইলিয়াম হার্স্ট” । যার কারণে পুলিৎজার ও “উইলিয়াম হার্স্ট” এর দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সূচিত হয় আরেকটি নতুন ধারা। যাকে আমরা চিনি “হলুদ সাংবাদিকতা” নামে ।

হলুদ সাংবাদিকতা কি এটার একটা ছোট ব্যখ্যা একটু পরেই দিবো । আপাতত আগের টপিকে ফিরে আসি । উইলিয়াম হার্স্ট ছিলেন এক বিলিয়নার এর বখে যাওয়া পুত্র। অদ্ভুত কারণে তিনি সাংবাদিকতাকে বেছে নেন। কিনে নিলেন পুলিৎজার পরিবারেরই একটি পত্রিকা – “দ্য জার্নাল” যার পরবর্তী নাম “নিউইর্য়ক জার্নাল” । আগে সংবাদপত্র কেবল প্রকাশ করতো বস্তুনিষ্ট ও বোরিং ধাঁচের সংবাদ ।
.
অসত্য তথ্য প্রকাশ ছিল চরমভাবে নৈতিকতার বিবর্জিত ঘটনা । পুলিৎজার ছিলেন সেই পথেরই পথিক । কিন্তু উইলিয়াম হার্স্ট কেলেঙ্কারির খবর, চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি খবর সত্যমিথ্যা , সত্য থেকে দুরে মিথ্যার কাছাকাছি ধরণের খবর দিয়ে তার সংবাদপত্রের কাটতি বাড়াতে লাগলো আর স্বাভাবিকভাবে সাথে পুলিৎজারের পত্রিকা নিচে যেতে থাকলো ।

উইলিয়াম হার্স্ট মোটা অঙ্কের টাকা-পয়সা দিয়ে পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নিলেন নিজের পত্রিকায়।

পুলিৎজার তার পেশায় সৎ ছিলেন বিধায় কিছু বলেননি তবে যতক্ষণ না …. হার্স্ট “রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট” কে ধরে টান দেয় । ওই কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাতায় একটি কার্টুন আঁকতেন এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা একদিকে যেমন চাঞ্চল্যকর হতো, অন্যদিকে তেমনি প্রতিপক্ষকে তির্যকভাবে ঘায়েল করত । (এমনটা করতে দেখা যায় আমাদের বেসিক আলী ক্যারেকটারটিকে) এবার পুলিৎজার হার্স্টের মতই নিচে নামলেন ।

দুজন মিলে শুরু করলেন হলুদ সাংবাদিকতার প্রথম অধ্যয় । পত্রিকার বিক্রি বাড়ানোর জন্য তার যা নয় তাই ছাপাতে লাগলেন । যার ফলশ্রুতিতে আমেরিকাকে অনেক মুল্য দিতে হরো । ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধজাহাজ হাভানার কাছে ডুবে যায়। হার্স্টের নিউইয়র্ক জার্নাল এজন্য স্পেনের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করে সংবাদ ছাপে । ফলে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস অধিবেশনে স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে নিউইয়র্ক জার্নালের হলুদ সাংবাদিকতার ফলস্বরূপ এক ‘অনুমান নির্ভর’ সংবাদ !

আজ সারা পৃথিবীতে হলুদ সাংবাদিকতার জয়জয়কার । এদের পথিকৃত কিন্তু এই দুই মহান সম্পাদক । যাদের তৈরীকৃত নিয়মগুলোর কারণে বর্তমান সংবাদমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাছে ঋণী । অথচ তাদেরকে ইতিহাস স্মরণ রেখেছে হলুদ সাংবাদিকতার পথিকৃত হিসেবে ।

তাদের ভালো খারাপ দুটো পদ্ধতিই পরবর্তী প্রজন্ম লুফে নিবে । নিচে হলুদ সাংবাদিকতার সম্পর্কে ছোট একটা ব্রিফ দিচ্ছে । আশা করি আপনারাও কোন সংবাদ হলুদ সাংবাদিকতার দোষে দুষ্ট বুঝতে পারবেন-

 ফ্র্যাঙ্ক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন:

• সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা।
.
• ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার।
.
• ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক রচনা আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার।
.
• সম্পূৰ্ণ রঙিন রবিবাসরীয় সাময়িকী প্রকাশ, যার সাথে সাধারণত কমিক্স সংযুক্ত করা হয়।
.
• স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো পরাজিত নায়কদের পদ্ধতির নাটকীয় সহানুভূতি। এমনটাই হবে বলে জোসেফ পুলিৎজার তার জীবনের শেষ লগ্নে বুঝতে পেরেছিলেন । সে মুহূর্তে তার সামনে উদাহারণ হিসেবে ছিল
আলফ্রেড নোবেল । যিনি সারা জীবনের দুর্নাম মুছতে নোবেল প্রাইজ ব্যবস্থা চালু করেন ।
.
তিনি তার পথেই হাটলেন । তার জীবনে সঞ্চিত অর্থের ৩ভাগের ২ভাগ তিনি কলম্বিয়া ইউনির্ভাসিটিকে দান করে যান সাংবাদিকতা পেশাকে উন্নতি করার জন্য । ১৯১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর কলম্বিয়া ইউনির্ভাসিটি তাঁর অর্থের কিছু অংশ দিয়ে ১৯১২সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা স্কুল গঠন করে এবং বাকি অর্থের মাধ্যমে ১৯১৭সালের ৪ঠা জুন প্রথম পুলিৎজার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয় । যা তাকে নোবেলের মতই ইতিহাসে অমর করে তুলেছে । এবং এই পুরস্কারটিকে সাংবাদিকতার নোবেলও বলা হয়।
.
বর্তমানে প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে ২১ টি বিভাগে পুরস্কারটি প্রদান করা হয়। একটি স্বাধীন বোর্ড বিজয়ী নির্বাচন করে থাকেন ।
.
জোসেফ পুলিৎজারকে একই সাথে একজন নায়ক ও খলনায়ক দুটো উপাধিতেই ভূষিত করা যায় ।
.
তবে উনি আমার কাছে একজন নায়ক রূপেই উজ্জ্বল থাকবেন । স্বীকার করি তিনি এই মিডিয়া জগতকে ভালো ও মন্দ দুটো পথই দেখিয়েছেন । কিন্তু আমাদের দায়িত্ব ছিলো তার ভালোটা গ্রহণ করা মন্দকে পরিত্যাগ করা।
(সংগ্রহীত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here