বদরুন নেসা নিপা: জাতিসঙ্ঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে আরো বলা হয় বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৩৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের এ হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। এ বিবেচনায় বাল্যবিয়ের হারে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন। এর ফলে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যাও তাদের ক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন। এ বয়সসীমায় মা হওয়া ৩০ শতাংশ নারী এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
শিক্ষা, সচেতনতা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও গোঁড়ামির কারণে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেয়ে শিশুর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বাল্যবিয়ের এ উদ্বেগজনক চিত্র যখন সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে তখন ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ছেলেদের ২১ এবং মেয়েদের জন্য ১৮ বছর বয়সের সীমারেখা রাখলেও ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ আদালতের নির্দেশনা মেনে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থে বিয়ে দেয়ার বিধান রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’ এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। অর্থাৎ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের সরাসরি বিরোধী।
এ প্রসঙ্গে আইনজীবী অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন বলেন, বাল্যবিয়ে এক দিকে আইন এবং সংবিধানের লঙ্ঘন, অন্য দিকে বাল্যবিয়ে বর ও কনেকে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ১৯২৯ অনুযায়ী কোনো এক পক্ষ কর্তৃক উল্লিখিত বয়স পূর্ণ না হলে তা বাল্যবিয়ে বলে গণ্য হয়। বর্তমান আইনে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ সাজা তিন মাস এবং জরিমানা এক হাজার টাকা। কিন্তু এর বাস্তবায়ন খুবই কম। প্রস্তাবিত আইনে বাল্যবিয়ের জন্য সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ দুই বছর ও জরিমানা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। বাল্যবিয়ের নিবন্ধনের জন্য নিবন্ধকের শাস্তি ও লাইসেন্স বাতিল হবে। বাস্তবতা হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বাল্যবিয়ে রোধ সম্ভব হচ্ছিল না, সেখানে আইনের এ সংস্কারের ফলে যখনই কোনো মেয়ের বা ছেলের বয়স ১৬ বা ১৮ এর কাছাকাছি তখনই বাবা-মা আদালতে গিয়ে সন্তানের বিয়ে দেয়ার জন্য মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবে। আদালতের নির্দেশ কিংবা বাবা মায়ের সম্মতি যে সুযোগই হোক, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের বিধান থাকলে সেই বিধানের অপব্যবহার হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকবে। আইনের ভেতরই যদি বিশেষ ধারা করে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় বা বিশেষ প্রেক্ষাপটের মতো উক্তি রাখা হয় তাহলে কিভাবে বাল্যবিয়ে এ আইন দ্বারা বন্ধ করা যাবে? আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজে চলতে হলে যেমন আইনের দরকার, আইনের পাশাপাশি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে সমন্বিত উদ্যোগে আইনগুলোও বাস্তবায়ন করা দরকার।
সমাজবিজ্ঞানী ফাহমীদা আহমেদ বলেন, ১৮ বছরের কম বয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে কখনোই পরিবারের গুরুদায়িত্ব দেখার মতো পরিপক্বতা লাভ করে না। কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য বাল্যবিয়ে একটি হুমকি। মেয়েদের বিয়ের বয়স কমালে তা কিশোরী মায়ের সংখ্যা বাড়াবে। এর খারাপ প্রভাব পড়বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে। প্রতিটি অঙ্গের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। ১৬ বছরের মেয়েদের অনেক অঙ্গই পরিপূর্ণতা পায় না। হরমোনের বিবেচনায় ১৬ বছরের নারী মা হতে পারে সত্যি, কিন্তু পরিপূর্ণ শারীরিক সক্ষমতা থাকে না। বাল্যবিয়ে কমানোর জন্য বয়স না কমিয়ে দরিদ্র ও নিরাপত্তার অভাবসহ যেসব কারণে বাল্যবিয়ে কমছে না সেসব কারণ দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। একই সাথে ছেলেমেয়ে উভয়কে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের জীবন বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করার দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে প্রশাসনকে। এবং নারীবান্ধব আইনগুলো শক্তিশালী করতে হবে। এর প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে, আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নতুন আইন প্রণয়ন থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনের প্রয়োগ। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। এনজিও কর্মী নাজমা রহমান বলেন, বিয়ের বয়স কমানোর ফলে দেশে বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে দেশে সরকারি বেসরকারিপর্যায়ে যে সামাজিক আন্দোলন ও প্রচারণা চলছে তা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত হবে এবং বাল্যবিয়ের পরিমাণ আরো আশঙ্কাজনকভাবে বাড়বে। সামাজিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকবে না।
পরিশেষে বলা যায়, জনসচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধ ও গণঐক্যের মাধ্যমেই নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে আমাদের প্রজন্ম হুমকি থেকে রেহাই পাবে, তেমনি দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে এবং আইনও বাস্তবায়ন হবে।