প্রচ্ছদ সফল নারী মেরা পর্বতে দুই বাঙালি মেয়ে

মেরা পর্বতে দুই বাঙালি মেয়ে

0
রীতা ভৌমিক: চলতি বছরের ১৫ অক্টোবর হিমালয়ের ‘মেরা’ পর্বত জয় করলেন বাংলাদেশের চার পর্বতারোহী। তাদের মধ্যে ছিলেন শায়লা পারভীন ও সাদিয়া সুলতানা। শায়লা পারভীন ২১ হাজার ২২৭ ফুট উঁচু ‘মেরা’ পর্বতশৃঙ্গে উঠে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন-

 

নেপালি সময়ে ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৭টা ২০ মিনিট। প্রচণ্ড বাতাসের বেগ। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড বাতাস আর ঠাণ্ডার মধ্যে হিমালয়ের ‘মেরা’ পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। প্রথমে তেমন কোনো অনুভূতি অনুভব করিনি। এটাই ছিল আমার প্রথম এত উচ্চতায় পর্বত আরোহণের অভিযান। আধঘণ্টার মধ্যে দলনেতা এমএ মুহিত, কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব ও আমি বাংলাদেশের লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উড়াই। জাতীয় পতাকা উড়ানোর ছবি তুলে আমাদের ক্লাব বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড টেকিং ক্লাবের পতাকা উড়িয়ে ছবি তুলি। এরপর স্পন্সরদের লোগো নিয়ে ছবি তুলি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন গাইড হিসেবে নেপালের বিশ্ব রেকর্ডধারী পর্বতারোহী ইস্পিট প্রেম্বা দর্জি শেরপা। তার স্ত্রী কাঞ্চি তামাংও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আধঘণ্টা আমরা ‘মেরা’ পর্বতের চূড়ায় অবস্থান করি। এর বেশি সময় সেখানে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ একদিকে প্রচণ্ড বাতাসের বেগ, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় অর্থাৎ আগের দিন রাত ১টা ৪৫ মিনিট থেকে সামিটের জন্য হাইক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করেছি।

সে জন্য আর দেরি না করে দ্রুত পাঁচজন নিচে নেমে আসি। হাইক্যাম্পে পৌঁছতে সকাল ১০টা বেজে যায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে স্যুপ আর চা, গরম পানি পান করে সকাল পৌনে ১১টার দিকে বেস ক্যাম্পে রওনা দিই। বরফের মধ্য দিয়ে টেকিং করে বেস ক্যাম্পে পৌঁছি দুপুর আড়াইটার দিকে। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে লজে দুপুরের খাবার খাই। এভাবেই হিমালয়ের ‘মেরা’ পর্বত অভিযানের অনুভূতি বললেন শায়লা পারভীন।

শায়লা বন্ধুদের সঙ্গে ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানেই তার পরিচয় হয় বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে। এই সদস্যদের মধ্যে এভারেস্ট বিজয়ী এমএ মুহিতও ছিলেন। ঢাকায় ফিরে তিনি এমএ মুহিতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এমএ মুহিতের কাছেই প্রথম বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সদস্য হন। এরপর এই ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের কিওকারাডং পাহাড়ে দশ দিনের টেকিংয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে হিমালয়ের মাউন্ট কেয়াজুরি পর্বতের বেস ক্যাম্প পর্যন্ত যান। বেস ক্যাম্পের উচ্চতা ছিল ১৫ হাজার ৫০০ ফুট। এই অভিযানে ভালো করায় এমএ মুহিত তাকে মাউন্টেনিয়ারিং প্রশিক্ষণে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। শায়লা পারভীন ২০১৬ সালের মে মাসে ভারতের উত্তর কাশীর মেহেরুন ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করেন।

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির মেয়ে শায়লা পারভীনের বাবা এসএমএ সালাম একজন ব্যাংকার। মা আইরিন সুলতানা গৃহিণী। স্বরূপকাঠিতেই তার বেড়ে ওঠা। স্বরূপকাঠি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ গোল্ডেন, ২০১১ সালে ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বর্তমানে সিটি ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

পর্বতারোহণের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজে পারিবারিক সহযোগিতা সম্পর্কে শায়লা পারভীন জানান, তার বাবা চাননি মেয়ে এ ধরনের কঠিন কাজে জড়িত হোক। কিন্তু মা তার আচরণ, ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু সরাসরি উৎসাহ দেননি সংসারে অশান্তি হওয়ার ভয়ে। কিন্তু ছোট ভাই-বোনেরা সব সময় উৎসাহ দিত তাকে।

উঁচু-নিচু পিচ্ছিল পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল : সাদিয়া সুলতানা

ঢাকা থেকে ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে নেপালের কাঠমুণ্ডুতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমাদের দলনেতা এমএ মুহিত, কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব, শায়লা পারভীন ও আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন ইস্পিট প্রেম্বা দর্জি শেরপা। তিনি একজন বিশ্ব রের্কডধারী পর্বতারোহী। মাত্র আট ঘণ্টায় তিনি বেস ক্যাম্প থেকে এভারেস্ট পর্বত শিখরে আরোহণ করেছিলেন। তিনি হলেন আমাদের হিমালয়ের ‘মেরা’ পর্বত অভিযানের গাইড। কাঠমাণ্ডুতে আমরা দু’দিন পর্বতারোহণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা ও প্রস্তুতির জন্য অবস্থান করি। ৭ অক্টোবর লুকলার উদ্দেশে রওনা হলাম সকালে। সঙ্গে গাইড ইস্পিট প্রেম্বা দর্জি শেরপা, তার স্ত্রী কাঞ্চি তামাং ও সহকারী গাইড লাকপা নুরু শেরপা। সকাল ৮টার মধ্যেই লুকলা পৌঁছলাম। লুকলা পৌঁছে একটি হোটেলে নাশতা সেরে অভিযানে বেরিয়ে পড়ি। টেকিং করতে করতে আমরা চুটেণ্ডার কাছাকাছি পৌঁছে যাই। চুটেণ্ডার ২০০ ফুট নিচে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে আবার গন্তব্যে রওনা দিই। ৪০ মিনিট টেকিং করে চুটেণ্ডা পৌঁছলাম। রাতটা একটি লজে কাটালাম। চুটেণ্ডা থেকে ছেত্রালা পাস (এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা) পার হয়ে আমরা দ্বিতীয় দিন তুলিখাড়গায় আসি। ছেত্রালার উচ্চতা ছিল চুটেণ্ডা থেকে প্রায় দ্বিগুণ। তুলিখাড়গার রাস্তা খুবই খারাপ ছিল বৃষ্টির কারণে। পিচ্ছিল পথ, এর ওপরে উঁচু-নিচু। চলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার সঙ্গীরা বিকেল ৫টায় পৌঁছে যায়। আমার পৌঁছতে ৪৫ মিনিট দেরি হয়। আমার সঙ্গে ছিলেন সহকারী গাইড লাকপা নুরু শেরপা। অন্ধকারে পথ দেখা যাচ্ছিল না। সহকারী গাইড লাকপা নুরু শেরপা উঁচু থেকে জোরে আওয়াজ দেন। আমার দলের অন্যরা লজ থেকে লাকপা নুরু শেরপার আওয়াজ শুনতে পান। ওরাও আওয়াজ দেয়। এর ফলে আমরা লজের অবস্থান বুঝতে পারলাম। রাতটা লজে বিশ্রাম নিই। সকালে নাশতা সেরে কোঠের উদ্দেশে রওনা দিই। এটি অনেক দীর্ঘ পথের যাত্রা ছিল আমাদের জন্য। হিংকু খোলার (নদী) পাশ দিয়ে উঁচু-নিচু রাস্তা বেয়ে কোঠে পৌঁছলাম। কোঠে রাতযাপন করে আবার যাত্রা শুরু হল আমাদের। পরদিন খাগনাক পৌঁছি। এখানে দু’দিন থেকে হিমালয়ের ‘মেরা’ বেস ক্যাম্প খারের উদ্দেশে রওনা দিই। খারেতে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর। ওইদিন ওখানে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বরফে আমরা অনুশীলন করি। সকালে হাইক্যাম্পের দিকে রওনা হব। কিন্তু আমার ধীরগতির কারণে পরে উপরে না ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ যদি সময় মতো পৌঁছতে না পারি তাহলে আমার জন্য দলের অন্য সদস্যদের সমস্যা হতে পারে। এই ভেবে আমি খারেতে থেকে গেলাম। এভাবেই সাদিয়া সুলাতানা বললেন তার ‘মেরা’ পর্বত অভিযানের গল্প।

সাদিয়া সুলতানা মাত্র চার বছর বয়সে বাবা শাহজাদা কামালকে হারান। ইরাকে সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যান। মা শিরিন কামাল একজন গৃহিণী। বাবার মৃত্যুর পর মামাবাড়ি ঢাকা ফরিদাবাদে চলে আসেন তারা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। নানি, মামা-খালাদের আদর-যতেœ বেড়ে ওঠেন। কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি, বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। এই পর্বতারোহণে তার বড় মামা গোলাম মোহাম্মদ রেজা রব্বানী সর্বাÍকভাবে সহযোগিতা করেন।

সাদিয়া সুলতানার ২০০২ সালে পরিচয় হয় অভিযাত্রী ইনাম উল হকের সঙ্গে। ইনাম উল হক উত্তর মেরু ভ্রমণ করেন। তার সঙ্গে পরিচয়ের পরই সাদিয়ার পর্বতারোহণের স্বপ্ন দেখেন। ইনাম উল হক ২০০৩ সালে বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড টেকিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বছরই সাদিয়া এই ক্লাবের সদস্য হন। বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড টেকিং ক্লাব থেকে ২০০৪ সালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যান তিনি। ভারতের দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে এ বছরেরই মার্চে বেসিক এবং সেপ্টেম্বরে এডভান্স মাউন্টেনিয়ারিং নামে পর্বতারোহনের ওপর দুটি কোর্স সম্পন্ন করেন। ২০১২ সালে আইল্যান্ড পিক জয় করেন সাদিয়া সুলতানা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক সপ্তাহেই গৃহহীন ৩০ হাজার রোহিঙ্গা
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বাস থাকতে হবে নিজের ওপরই : ক্যাথরিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here