আহমদুল ইসলাম চৌধুরী : আরাকান, বর্তমান নাম রাখাইন। আরাকানবাসীর সঙ্গে এ দেশের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তা হাজার বছরের অনেক আগের কথা। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উপমহাদেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত আত্মীয়তা ব্যবসা-বাণিজ্য যোগাযোগের মাধ্যমে নানাবিধ সম্পর্ক এ সখ্য বিরাজমান ছিল।
চট্টগ্রামের পাশাপাশি আরাকানের সঙ্গেও পবিত্র আরব ভূমির যোগাযোগ ছিল। আরকানি মুসলমানরা ৮ম শতকের প্রবাসী আরব এবং স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলিম বংশোদ্ভূত। পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়ায় পারস্য, ভারতবর্ষ থেকে অনেকে ধর্মপ্রচার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের লক্ষ্যে আরাকানে বসতি স্থাপন করেন। আরও অনেক পরে ব্যবসা-চাকরির সন্ধানে অনেকে এখানে আসেন। তবে আরাকানে বসবাসকারী সবাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৪৩০-১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনবিশিষ্ট রোহিঙ্গা স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। রাজা নারামেখলা ১৪৩০-১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা হিসেবে রাজ্য চালিয়েছেন। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাংলার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আরাকানে বাংলায় ইসলামী স্বর্ণ মুদ্রা চালু করেন। ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহর মৃত্যু হলে রাজা নারামেখলার উত্তরসূরিরা ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে রামু ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম দখল করে। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। যদিওবা এর মধ্যে চট্টগ্রাম দখল নিয়ে আরাকান রাজা ও ত্রিপুরা রাজার মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস রয়েছে।
বার্মিজ রাজা বোদাওয়ায়া আরাকান রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধদের আধিপত্য শুরু হয়। তবে আরাকানে ধর্মের দিক দিয়ে বৌদ্ধ হলেও ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এতে তারা মুসলিম পদবি ও নাম ব্যবহার করতেন। তারা মুসলমানকে রাজকীয় উচ্চ পদে নিয়োগ দিয়েছিল। ভাগ্যাহত শাহ্ সুজা আরাকানে আশ্রয় নিলে মুসলমানগণের আধিপত্য প্রত্যক্ষ করেছিল। বাদশা আওরঙ্গজেবের নির্দেশে নবাব শায়েস্তা খান আরাকান নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম দখলে নিলেও মূল আরাকান তাদের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়।
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মা (মিয়ানমার) আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়। এ থেকে মুসলমানদের প্রতিকূল অবস্থা শুরু হয়। এরা মগ তথা বর্বর। পরবর্তী ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে বার্মার সঙ্গে ব্রিটিশের যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ব্রিটিশরা বার্মাকে ব্রিটিশ ভারতের অধিকারে নিয়ে আসে এবং এ বার্মা অঞ্চল ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। তখন আরাকানও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি বার্মা ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এতে আরাকানে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতার স্বপ্ন চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে বার্মায় সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে রোহিঙ্গাদের প্রতি গণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে আরও কঠোর অবস্থানে যায়।
ব্রিটিশরা বার্মায় ১৩৯টি জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে কিন্তু তার মধ্যে এ রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ব্রিটিশ শাসকদের এ ভুলের খেসারত আজও দিচ্ছে আরাকানের রোহিঙ্গারা। ফলে বার্মা সরকার ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গা এর মধ্যে নেই।