প্রফেসর ড. এ. কে. এম ইয়াকুব হোসাইন:বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে শিল্পনগরী টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে শুরু হতে যাচ্ছে তাবলিগ জামাতের মহাসমাবেশ ‘বিশ্ব ইজতেমা’। গতকাল ১৩ জানুয়ারি (শুক্রবার) পবিত্র জুম্মাবাদ আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম ধাপ। ১৫ জানুয়ারি (রবিবার) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথম ধাপের ইজতেমা। এরপর চারদিন বিরতি দিয়ে ফের ২০ জানুয়ারি (শুক্রবার) শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপ। একইভাবে ২২ জানুয়ারি (রবিবার) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে ২০১৭ সালের ৫২ তম বিশ্ব ইজতেমা।
ইজতেমায় অংশ নেয়া মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় গত ছয় বছর থেকে দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লিদের দুইভাগে ভাগ করা হচ্ছে। এক বছর পর পর ৩২ জেলার মুসল্লিরা ইজতেমায় অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। জেলার মুসল্লিরা দুইভাগে ১৬ জেলা করে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন। গত বছর যে ৩২ জেলার মুসল্লিরা দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়েছিলেন, ঐ ৩২ জেলার মুসল্লিরা এ বছর ইজতেমায় অংশ নিতে পারছেন না। ১৬৫ একর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ইজতেমা মাঠে বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশ থেকেই তাবলিগ জামাত অনুসারী ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা অংশ নেন। বিশ্ব ইজতেমায় তাবলিগ জামাতের শীর্ষ আলেমদের বয়ান শোনেন। পরে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেয়ার জন্য জামায়াতবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যান। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের তাবলিগ অনুসারীরা মিলিত হন এ তুরাগ তীরে।
তাবলিগ জামাত ও ইজতেমার ইতিহাস: হযরত ইলিয়াস (রহ) ১৩৫১ হিজরি সালে হজ থেকে ফিরে আসার পর সাধারণ মুসলমানদের দুনিয়া ও সংসারের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে ছোট ছোট দলবদ্ধ করে, মসজিদের ধর্মীয় পরিবেশে অল্প সময়ের জন্য দীনি শিক্ষা দিতে থাকেন। এরই মাঝে একদা তিনি হুজুরে আকরাম (স) কে স্বপ্নে দেখেন এবং মহানবী (স) তাকে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের জন্য নির্দেশ দেন। মহানবী (স) এর নির্দেশ মোতাবেক তিনি দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের সূচনা করেন। তারপর এ কাজকে আরও বেগবান ও গতিশীল করার জন্য এ উপমহাদেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, পীর মাশায়েখ ও বুজুর্গানদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করা হয় এবং দিল্লির নিকটস্থ মেওয়াতে সর্বস্তরের মুসলসমানের জন্য ইজতেমা বা সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ক্রমেই তাবলিগের কার্যক্রম বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের গন্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের আনাচে-কানাচে। হযরত মাওলানা আবদুল আজীজ (রহ) এর মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলিগের মেহনত শুরু হয়। তারপর ১৯৪৬ সালে বিশ্ব ইজতেমা সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের তাবলিগের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে। পরে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা শুরু হয়। এর পরে ১৯৫৮ সালে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, তারপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গীর পাগারে এবং সর্বশেষে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর ভবেরপাড়া তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা এবং সেই থেকে এ পর্যন্ত সেখানেই ১৬০ একর জায়গাতে তাবলিগের সর্ববৃহত্ ইজতেমা বা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
কর্মসূচি: তাবলিগ শব্দের অর্থ প্রচার। মানুষের কাছে গিয়ে ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান জ্ঞাত করা ও ইসলামের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করাই হচ্ছে তাবলিগ। তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা দলবদ্ধ হয়ে মসজিদে অবস্থান নিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। এই তাবলিগ যারা বাস্তবায়ন বা সমর্থন করেন তাদের মহামিলন হল বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমার মূল কর্মসূচির মধ্যে থাকে: আ’ম বয়ান, ছয় উসূলের হাকিকত, বিদেশে নতুন জামাত প্রেরণ, তাশকিল, দরসে কোরআন, নতুন চিল্লা তৈরি ও যৌতুকবিহীন বিয়ে।
ইজতেমার কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হয়: বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। ‘মাখলুক কিছুই করতে পারে না খালিক ছাড়া’ এ সত্যকে বুকে ধারণ করে দাওয়াতে দীনের চেতনাকে শাণিত করার অদম্য স্পৃহা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আগত লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ। বিশ্ব ইজতেমা শুরু হওয়ার ৪০ দিন আগে বিশেষ তাবলিগি সমাবেশ দেশ-বিদেশের তাবলিগের মুরুব্বিরা জোড় ইজতেমায় বসে বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করেন। বর্তমানে প্রায় সারাবিশ্বে তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের কার্যক্রম চলছে। ৬টি উসূলের ওপর ভিত্তি করে এ আন্দোলন। উসূলগুলো হচ্ছে- কলেমা, নামজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমীন, সহি নিয়ত এবং তাবলিগ।
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব ইজতেমার গুরুত্ব ও তাত্পর্য অপরিসীম। মুসলিম বিশ্ব ইতিহাসের এক নাজুক ও দুর্দিন অতিক্রম করেছে। আফগানিস্তান, ইরাক ও ফিলিস্তিনে নির্বিচারে মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসে স্বাধীনভাবে নামাজ আদায় করা যাচ্ছে না। ইসরাইলী ইহুদীরা বারবার ফিলিস্তিনের ভূখন্ডে অনুপ্রবেশ করে হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহের সদস্যদের সেখান থেকে চিরতরে উত্খাত করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সভ্যতার লীলাভূমি ইরাকের শত শত মসজিদ ও জনপদ ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের দুরবস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে ঐক্যহীনতা ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ। এ পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সম্মেলনের (ইজতেমা) অনেক গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্ব ইজতেমায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা এসে সমবেত হন। এতে পারস্পরিক জানাজানি হয়। এখানে একত্রিত হয় নানা দেশের, নানা ভাষার, নানা বর্ণের মুসলমান এক মহান প্রভুর বান্দা মোহাম্মদ (স) এর উম্মত ও তার নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতির অনুসারী এবং কোরআনে বিশ্বাসী হিসেবে। গোটা মিল্লাত এক দেহের মত। এখানে এসে সবাই হাজির হন এক মন ও এক দেহ হিসেবে। তাই বিশ্ব ইজতেমা মিল্লাতের বৃহত্তর ঐক্যপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে পারে, যা মুসলিম বিশ্বের চলমান পরিস্থিতির প্রধান কারণ। বিশ্ব ইজতেমায় কোন সংঘাত-সংঘর্ষ ছাড়াই লাখ লাখ মানুষের এক সঙ্গে অভিন্ন উদ্দেশ্যে অবস্থান, একই অবস্থায় পানাহার গ্রহণ, একই বক্তার নছিহত শ্রবণ, একই ইমামের পেছনে আমীর-ফকির, আশরাফ-আতরাফ নির্বিশেষে সালাত আদায় এটাই প্রমাণ করে যে, মুসলমানরা ইচ্ছা করলে আজও সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যেতে পারে। অন্তত মৌলিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে গোটা মুসলিম বিশ্ব এক মন ও এক দেহের মত একই কালেমার ছায়াতলে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
লেখক: ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।