নারী ডেক্স: জামদানি বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের গৌরব। জামদানি নামের মূল উৎস অনেকটাই অজানা। তবে অনেকের মতে ‘জাম’ একটি ফারসি শব্দ। এর অর্থ উৎকৃষ্ট মদ। আর ‘দানি’ অর্থ পাত্র। তাই জামদানির অর্থ দাঁড়ায় উৎকৃষ্ট মদের পাত্র। নামের এ ধরন থেকেই ধারণা করা যায়, জামদানি শিল্প অনেক প্রচীন এবং এর বিস্তৃতি ছিল বিশ্বজুড়ে।
তোফায়েল আহমেদ রচিত আমাদের প্রাচীন শিল্প গ্রন্থে রয়েছে জামদানির নানা কথা। এ দেশে জামদানি এসেছিল মসলিনের পরিপূরক হয়ে। তাই মসলিনের সঙ্গে জামদানির তেমন কোনো সূক্ষ্ম পার্থক্য নেই। কারণ প্রাচীনকালে বাংলাদেশে উৎপাদিত যে কোনো বস্ত্রই মসলিন নামে পরিচিত ছিল। সে জন্য মসলিন তৈরির মূল লক্ষ্যগুলো জামদানিতে দেখা যায়।
মোগল আমলে মসলিনের পাশাপাশি জামদানি শিল্প পূর্ণ বিস্তার পায়। এর জন্য সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের অবদান অনেক। তিনি জামদানিকে মোগল হেরেমের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। সে সময় জামদানি ‘আঙরাখা’ বা পোশাকে ব্যাপক ব্যবহার হতো, যা নারী-পুরুষ সবাই পড়তেন। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান চিত্রকলার দরবার ভার্সিলি ও লন্ডনের নারীদের পোশাকে জামদানি গজ কাপড়ের ব্যবহার দেখা যেত। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতেও রাজ দরবারে জামদানির ব্যবহার দেখা যায়। তখন মূল্যবান সম্পদ হিসেবে জামদানি ঢাকা থেকে আগ্রা, বোখারা, সমরখন্দ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য হতো। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতেও শতাধিক পণ্য বাংলা থেকে ইউরোপিয়ানরা হামবুর্গ, লন্ডন, মাদ্রিদ, কোপেনহেগেনসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করত, তার মধ্যে জামদানি অন্যতম ছিল।
তবে মসলিন আর জামদানি একই পরিবারের হলেও মসলিনের সূক্ষ্মতা, নকশা ও গুণের দিক থেকে একে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হতো। যেমন- শবনম, তানজেব, সরবন্দ, নয়ন সুখ, জঙ্গল খাস, হানান, নিরাভরণ, ধরল, ডোরা, সরকার-ই-আলী, মবলুস খাস, আব-ই-রওয়ান, সরবতী, জামদানি ও চারখানা জামদানি ইত্যাদি। সে দিক থেকে জামদানিকে মসলিনের একটি প্রজাতি বলা যায়। কিন্তু উল্লেখিত মসলিনের বৈশিষ্ট্য থেকে জামদানির বিশেষ পার্থক্য হল- জামদানির পাড় ও জমিনে বিভিন্ন রঙের অপেক্ষাকৃত মোটা সুতায় বুননের মাধ্যমে অনেক দৃশ্য ও নকশার কারুকাজ। এছাড়া এর জমিন তৈরিতেও নানা রঙের সুতা ব্যবহার করে নকশায় আনা হয় ভিন্নতা। অন্যদিকে মসলিন হয় অনেক সূক্ষ্ম ও শুভ্র।
জামদানির প্রধান বৈশিষ্ট্য দুটি। এর একটি হল- বৈশিষ্ট্যমূলক জ্যামিতিক প্যাটার্নের ধারাবাহিকতা যেটি ইরানি নকশার ঐতিহ্যে প্রভাবিত ও অন্যটি হল এর মোটিফ বুননের সময় কাপড়ে দারুণভাবে গেঁথে যায়।
জামদানির নকশা তার ঐতিহ্যের মতোই উজ্জ্ব¡ল। জামদানির জমিনের নকশা মূলত তিনটি শ্রেণীভুক্ত। তা হল- বুটা, জাল ও তেছরি। একটি বিশেষ ফুলেল মোটিফ যদি বিচ্ছিন্নভাবে জমিনে বিছানো থাকে তাকে বলে বুটিদার বা বুটা। এছাড়া ফুলের নকশার কোনাকোনি বিন্যাসকে বলে তেছরি আর মোটিফের সংযুক্তিকে বলে জাল। জামদানির এসব মোটিফ তাঁতিদের পারিপার্শি^ক পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবিত বলে মোটিফগুলোর নাম তাঁতিভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
জামদানি বুননের কাজ হয় অনেকটা খোলামেলা ঘরে। তবে তাঁতের কাছে আলো রাখা হয় বেশি। দুইজন তাঁতি একসঙ্গে বুননের কাজ করেন। একজন মূল কারিগর, অন্যজন সহকারী কারিগর। মূল কারিগর তাঁতের ডানপাশে বসেন। আর সহকারী বসেন বামপাশে। বুননের সময় তাঁতিরা আঙ্গুলের মাধ্যমে সুতাকে টানা সুতার মধ্য দিয়ে চালনা করে নকশা ফুটিয়ে তুলেন। পরে সুতার মোটিফ অনুয়ায়ী পাড়, আচলে রঙ অনুয়ায়ী বিভিন্ন মাকু ব্যবহার করে জমিন বুনেন। জামদানির বুননের উন্নত মাকু তৈরি হয় তেঁতুল গাছ বা বাঁশ থেকে। এক সময় জামদানি বুনন ও নকশা হতো তাঁতিদের নিজস্ব চিন্ত-চেতনায় ও লোকজ জ্ঞানে। আর এখন তাঁতিদের বুনন কৌশলের সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের ফ্যাশন ডিজাইনারদের সাম্প্রতিক সময়ের নানা ভাবনা। ফলে জামদানির রঙে ও নকশায় এসেছে নানা বৈচিত্র্য। সেই সঙ্গে জামদানি শাড়ির পাশাপাশি এর ব্যবহার এখন অন্যান্য পোশাকেও হচ্ছে। এছাড়া এক সময় কেবল একশ্রেণীর অভিজাতরা জামদানি ব্যবহার করলেও এখন এর ব্যবহার করছে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ফ্যাশন সচেতন নারীরা।