মাহমুদা আক্তার নীনা : দিবানিশি নামাজ কোরআন পড়েও তা না বোঝার কারণে আমাদের অবস্থা দিকভ্রান্ত ঝড়ের পাখির মতো, যেন ঝড়ের পাখি হয়ে ওড়ে, যেতে হবে কত দূরে, জানা নেই তার সীমানা, সে যে হারিয়েছে তার ঠিকানা। এ ছাড়া দেখা যায়, এ দেশে সিংহভাগ কোরআনে হাফেজই কোরআন বোঝেন না ও কোরআন জানেন না। এত বড় কোরআনখানি কণ্ঠস্থ করেও তাদের অবস্থা যেন সাত সাগর পাড়ি দিয়ে তারা সৈকতেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন, সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছার সৌভাগ্য তাদের হয় না।
কোরআনের শিক্ষা ও জানা তো উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির হাতিয়ার। কেননা কোরআন হচ্ছে মানুষের মহাজ্ঞানভাণ্ডার; কিন্তু তারা এ জ্ঞানভাণ্ডার থেকে কিছুই অর্জন করতে পারে না। আল্লাহর কিতাবের শিক্ষা ও জ্ঞান ছাড়া তারা লক্ষ্যে পৌঁছবে কী দিয়ে? সুতরাং উম্মাহর ভাষাগত ঐক্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। সব জাতিসত্তার নিজ নিজ ভাষা বা মাতৃভাষার কোরআনের শিক্ষা ও জ্ঞানকে সবার জন্য মুক্ত করতে হবে। কেননা মাতৃভাষা গণবোধগম্য ভাষা ও প্রাকৃতিক বোধগম্য ভাষা। তাই তো মাতৃভাষা প্রাণচঞ্চল বহতা নদীর মতোই ছন্দময়। মাতৃভাষার অধিকার সমৃদ্ধ জাতির জীবন হয় ছন্দময়।
অপরদিকে মাতৃভাষায় অধিকারহারা জাতির জীবনে ঘটে ছন্দপতন। সে জাতির জীবন যেন ছন্দহারা নদীর মতোই ভেসে যায়, চলার শেষ কোন সুদূরে তার ঠিকানা জানা নেই। সুতরাং ধর্মের ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো মূল্যেই হোক জাতির মায়ের পরভাষার পরাধীনতার ও দাসত্বের শেকল ভাঙতে হবে। জাতিকে ঔপনিবেশিক মন-মানসিকা থেকে বের করে আনতে হবে। কেননা অন্ধ মন-মানসিকতার কারণে আমরা যুগ যুগ ধরে আলো ভেবে আঁধারকেই বুকে আঁকড়ে রেখেছি। মিথ্যে ও বিভ্রান্তকে সত্য ও সঠিক জ্ঞান করছি; কিন্তু কোরআনের সূরা বালাদে আল্লাহ বান্দার দাসত্ব ও পরাধীনতার শেকল ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন। দুর্গম পথে চলার হিম্মত অর্জন করতে এবং চলার হিম্মত দেখাতে বলেছেন। তাই তো বলেছেন, আমি কি তোমাদের (ন্যায় অন্যায়) দুটি পথ বলে দেইনি? কিন্তু তারা তো দুর্গম পথে চলার হিম্মত দেখায়নি। এ দুর্গম পথ হল কাউকে দাসত্বের শেকল থেকে মুক্ত করে দেয়া। সুতরাং জাতিকে পরভাষার দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে। কেননা বোধগম্যহীন ভাষা শিক্ষা ও জ্ঞান বিনাশী, জাতি বিনাশী। চিন্তানাশক, চেতনানাশক তাই কোনো জাতিকে বিজাতির ভাষার আগ্রাসনের মতো বড় ও ভয়াবহ কোনো নাশকতা নেই।
বিজাতির ভাষা গণবোধগম্যহীনতার দোষে দূষিত। শিক্ষা ছাড়া দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন, সমৃদ্ধ কিংবা শক্তিশালী জাতি গঠন কখনই সম্ভব নয়। তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকেই হতে পারে সবকিছুর নির্ভরযোগ্য সমাধান। মাতৃভাষার গুরুত্বের কারণেই আল্লাহ তার একেক জাতির মাতৃভাষায় বা জাতিসত্তার ভাষায় নাজিল করেছেন। আল্লাহ তো পৃথিবীর বাস্তবতায় প্রমাণ করেই দিয়েছেন যে, বোধগম্য শক্তির মানদণ্ডেই মতৃভাষা শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষে। মাতৃভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞান (কোরআনের) নিয়েই আমরা হতে পারি আলোর অভিযাত্রী। সুতরাং উপনিবেশবাদ নিপাত যাক।
আল্লাহ তার নবী-রাসূলদের মাঝেই আরবি ভাষার ঐক্য সৃষ্টি করেননি এবং কিতাবের মাঝেও আরবি ভাষার ঐক্য সৃষ্টি করেননি। বরং বান্দাদের ভাষার ভিন্নতার কারণে একেক কিতাব একেক জাতির ভাষায় নাজিল করেছেন। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর ভাষাগত ঐক্যের (আরবি ভাষায়) কোনো যুক্তি ভিত্তি নেই। এবং কোনো অপরিহার্যতাও নেই। এ ঐক্য আল্লাহ বিধানের পরিপন্থী। আর আল্লাহ সূরা ইউসুফের ৪০ আয়াতে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, বিধান দেয়ার এখতিয়ার বা অধিকার একমাত্র তাঁরই। সুতরাং জ্ঞান, বুদ্ধি বিবেক ও আল্লাহর হেদায়েতের মাপকাঠি পরিত্যাগ করে বাপ-দাদা কিংবা ধর্মীয় নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণের নীতি ইসলামে যুক্তি যুক্ত নয়।
আল্লাহর বিধান অযৌক্তিক অন্ধ বিশ্বাস বা কুসংস্কার চলবে না, অযৌক্তিক এ অন্ধভাবে কারো অনুসরণ করা যাবে না। তবুও কুপ্রথা, কুসংস্কার বা অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস চলমান আছে সামাজিকতার নামে ধর্মের নামে। তাই তো আমরা সভ্যতার দীপ্র দুপুরে এসেও ধর্মের নামে, সামাজিকতার নানারকম কুপ্রথা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস আঁকড়ে আছি। এখন আমরা চাই সব জাতির ভাষায় কোরআনের শিক্ষা ও জ্ঞানমুক্ত হোক, সব জাতি মাতৃভাষায় নামাজ-কোরআন পড়–ক। জগৎ থেকে অসত্য-অন্যায় যত ডুবে যাক। সত্যের প্রসাদ পিয়ে সব জাতিই লাভ করুক অমৃতের স্বাদ। আমি মাতৃভাষায় নামাজ-কোরআন পড়ি। আমার বাঙালিত্বের পূর্ণতা উপলব্ধি করি। চেতনায় মাতৃভাষাকে ধারণ করি পূর্ণরূপে। আমি বাঙালি, বাঙালিত্বের জগৎজুড়ে বিচরণ করি। সবার জন্যও তাই কামনা করি।
লেখক : কোরআন গবেষক, প্রাবন্ধিক
ইমেইল : mahmuda1959@yahoo.com