‘লাইলাতুল ক্বদর’ মানে হচ্ছে ক্বদরের রাত। ক্বদর অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। অর্থাৎ মাহাত্ম্যপূর্ণ রাত্রি ও সম্মানীয় রাত্রি। এ রাতের বিরাট মাহাত্ম্য ও অপরিসীম মর্যাদার কারণে রাতকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ বা মহিমান্বিত রাত বলা হয়।
গবেষক আবু বকর ওররাক (র.) বলেন, এ রাত্রিকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতের পূর্বে আমল না করার কারণে যাদের কোনো সম্মান মর্যাদা, মূল্যায়ন ছিল না, তারাও তাওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদত এর মাধ্যমে এ রাতে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যান। (তাফসীর মা’রিফুল কুরআন)
আরেক অর্থে ক্বদর মানে তাকদীর বা নির্দিষ্ট ও ধার্যকরণ বা আদেশদানও হয়ে থাকে। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণ লিখে দেয়া হয়। এমনকি এ বছর কে হজ্জ করবে তাও লিখে দেয়া হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর বক্তব্য মতে চারজন ফেরেশতাকে এসব কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়। তারা হলেন, ইসরাফিল, মীকাঈল, আযরাঈল ও জিরাঈল (আ.)। (কুরতুবী)
পবিত্র কুরআনের সূরা দুখান এর শুরুর দিকে আয়াতটিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘যে বরকতময় পবিত্র রাতে তাকদীর বা অদৃষ্ট সংক্রান্ত সব ফায়সালা লিপিবদ্ধ করা হয়।’ অধিকাংশ তাফসীরবিদগণের মতে সেই বরকতপূর্ণ রাত্রি হচ্ছে ‘লাইলাতুল ক্বদর’।
মোটকথা, এ মহিমান্বিত রাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। পবিত্র কুরআনও ত্রিশপারা একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিলো এ রাতেই। এ রাতের ফযীলত ও মর্যাদার বিষয়ে খোদ আল্লাহ তা’য়ালা সূরাতুল ক্বদর নামের একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন। এর চেয়ে বড় মাহাত্ম্য ও মর্যাদা আর কি হতে পারে? আল্লাহ নিজেই এ রাতের মহিমা বর্ণনায় বলেছেন, ‘ক্বদরের রাত্রি এক হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ’ (৯৭:০৩)। অর্থাৎ কারো এক নাগাড়ে এক হাজার মাস বা ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত ইবাদত করার যে ফযীলত বা সওয়াব পাওয়া যায়; তা এ এক রাতের ইবাদতের দ্বারাই মহান আল্লাহ প্রদান করে থাকেন। সুবহানাল্লাহ।
সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে এবং সাওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় এ রাতে রাত্রি জেগে ইবাদত-বন্দেগি করবে, তার পূর্ববর্তী জীবনের সকল পাপ মোচন করে দেয়া হবে।’
উম্মতে মুহাম্মদীর (সা.) এর ক্ষেত্রে উক্ত বিশেষ সুযোগ দানের কারণ হচ্ছে, এদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উম্মতও যে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত তার অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা। তাবে প্রাসঙ্গিকভাবে সূরা ক্বদর এর অবতীর্ণের প্রেক্ষিত প্রশ্নে বলা হয়েছে- প্রিয়নবী (সা.) একদা বনী ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে বললেন, সে অবিরাম এক হাজার মাস পর্যন্ত জিহাদে ব্যস্ত খাকেন এবং কখনো অস্ত্র হাত থেকে রাখার সুযোগ পায়নি।
বর্ণনান্তরে ইবনে জারার (র.) অপর একটি ঘটনার কথা বলেছেন, বনি ইসরাঈলের জনৈক এবাদতকারী সমস্ত রাত্রি ইবাদতে কাটিয়ে দিত, এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। এভাবে সে এক হাজার মাস পর্যন্ত কাটিয়ে দিত। এসব ওয়াজ-উপদেশ শুনে সাহাবিকিরাম এর মনে প্রচণ্ড বিস্ময়ের পাশাপাশি দারুণ পরিতাপও হত যে, আমরা তো এত বছর বাঁচার বা দীর্ঘ হায়াত পাওয়ার সুযোগ দেখছি না। সুতরাং সেই মর্যাদা প্রাপ্তিও তো সুদূর পরাহত।
এসব পরিতাপের দাবীতে এবং শ্রেষ্ঠত্বের পূর্ণতা দানের সুযোগ হিসাবে মহান আল্লাহ সূরা ক্বদর নাযিল করে মুসলিম উম্মাহকে তার চেয়েও বড় ও বেশি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ করে দিলেন। আর তা এভাবে যে, এ উম্মতের শুধু একরাতের ইবাদতই ৮৪ বছরের চেয়েও বেশি পূন্য অর্জিত হয়ে যাবে। সুতরাং সে ৬০/৭০ বছরের জীবনে প্রতিবছরই উক্ত সূবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে নিজেকে ধন্য করেতে সক্ষম হবে।
ই’তিকাফের গুরুত্ব
উক্ত সূবর্ণ সুযোগ তথা ক্বদরের রাত্রি কবে? তার জবাবে খোদ পবিত্র কুরআনেই বলা হয়েছে, ‘তা হচ্ছে মাহে রমযানে। যাতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ সহীহ হাদিসে মহানবী (সা.) তা মাহে রমযানের শেষ দশকে এবং বেজোড় রাতে তালাশ করতে বলেছেন। তিনি (রাসূল) নিজেও মাজে রমযানের শেষ ১০ দিনে, রাতদিন পরিপূর্ণ সময়টি স্বেচ্ছায় মসজিদে বন্দি থেকে বা অবস্থানগ্রহণ করে সেই ক্বদরের রাত্রি পাওয়ার প্রত্যাশায় কাটিয়ে দিয়েছেন। আর এটাকেই বলা হয়, ই’তিকাফ। তাই মাহে রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করা উম্মতের জন্য সুন্নতে কিফায়া।
সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা রমযানের শেষ দশকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’কে তালাশ করো। সহীহ মুসলিম শরীফে বলা হয়েছে, তোমরা তা শেষ দশকের বে-জোড় রাতে তালাশ করো। (তাফসীরে মাযহারী)। এসব বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, ‘লাইলাতুল ক্বদর’ প্রাপ্তিতে ই’তিকাফের গুরুত্ব কত বেশি! অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে তা প্রাপ্তিতে শেষ দশকের ই’তিকাফ অবশ্যই সহায়ক। যে কারণে প্রিয়নবী (সা.) মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি রমযানেই ই’তিকাফ পালন করে গেছেন।
‘লাইলাতুল ক্বদর’ প্রাপ্তির প্রসঙ্গ ও উদ্দেশ্য ছাড়াও মাহে রমযানের শেষ মুহুর্তে ইবাদত-বন্দেগির পরিমাণ বৃদ্ধির সূবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর স্বার্থেও ই’তিকাফ করা হয়ে থাকে। তাই যথাসাধ্য সবার ই’তিকাফের সুযোগ গ্রহণ করা সমীচীন।
এই ই’তিকাফের ফযীলত ও গুরুত্ব উপলদ্ধির জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, মহান আল্লাহ নিজেই পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় ও সূরা হজ্জে ই’তিকাফের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈল কে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারি, ই’তিকাফকারি ও রুকু সিজদাকারিদের জন্য পবিত্র রাখো। (০২:১২৫) একই ই’তিকাফ বা মসজিদে অবস্থান নিয়ে সূরা বাকারার ১৮৭ এবং সূরা হজ্জের ২৫-২৬ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ প্রাপ্তি ও এই রাতে সঠিকভাবে ইবাদতের তাওফিক দান করুন।
মুফতি মহিবুল্লাহিল বাকী
পেশ ইমাম
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম