প্রচ্ছদ আন্তর্জাতিক হোয়াইট হাউসের অ্যাডভাইজার

হোয়াইট হাউসের অ্যাডভাইজার

0

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুমানা আহমেদ হোয়াইট হাউসের অ্যাডভাইজার। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিরাপদ রাখতে কাজ করেন হিজাব পরা এই নারী। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন মো. নাভিদ রেজোয়ান


 

নিজেকে হিজাবি পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না রুমানা। অন্যরা যখন শার্ট-প্যান্টে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত তখন তিনি হিজাবে মাথা ঢেকে আমেরিকার সবচেয়ে নামি বাড়িটা তত্ত্বাবধান করতে যান। তিনি বারাক ওবামার সহকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডসের উপদেষ্টা। রাষ্ট্রীয় অনেক স্পর্শকাতর ও গোপন বিষয় তিনি হেফাজত করেন। তাঁর বয়স ২৭।
যেভাবে হোয়াইট হাউসে…
রুমানা যখন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন তখন হোয়াইট হাউসে ইন্টার্ন হওয়ার আবেদন জানান। প্রেসিডেন্ট ওবামার পরিবর্তনের বাণীতে তিনি উৎসাহবোধ করতেন। তবে তখন ভেবেছিলেন, কিছুদিন কাজ করেই বিদায় নেবেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি কাজের ব্যাপকতা দেখে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন, এখানে করার আছে অনেক কিছু। যা-ই হোক, ইন্টার্ন শেষ হলে তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পরে হোয়াইট হাউস থেকে আবার ডাক পান। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে থাকেন এবং পদোন্নতি লাভ করেন। বাল্টিমোরে ওবামার মসজিদ পরিদর্শনের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব ছিল তাঁর। তিনি প্রেসিডেন্টের ভাষণ লিখতেও সাহায্য করেছিলেন।
যেমন মানুষ
মানসিকভাবে খুব শক্ত মানুষ। বাধা ডিঙানোর সাহস রাখেন। বিশ্বাস করেন, শান্তিপূর্ণ উপায়েই ইসলামবিদ্বেষীদের জবাব দেওয়া যায়। তিনি দেশের মানুষের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখেন এবং মনে করেন, আমেরিকা সব বাধা পেরিয়ে যেতে পারবে। ষাটের দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের কথা তুলে তিনি বলেন, ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ সমস্যা আর কষ্টের মধ্যেও ঐক্য গড়ে তুলতে পারে এবং আনতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নও তাঁর আগ্রহের বিষয়।
ছোটবেলায় একবার হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন
অন্য দর্শনার্থীদের মতোই তিনি হোয়াইট হাউস দেখতে গিয়েছিলেন ছোটবেলায়। কিন্তু এখানে কাজ করবেন ভাবেননি। যখন চাকরি করতে এলেন তখন ভয় পেয়েছিলেন কিছুটা। শঙ্কা ছিল, সহকর্মীরা একজন হিজাবিকে সহজভাবে নিতে পারবে তো? তবে অল্পদিনেই তাঁর শঙ্কা কেটে গিয়েছিল। সবাই সহযোগিতা করেছেন।
বেন রোডস বলেন…
আমি প্রতিদিন তাঁর ওপর নির্ভার হয়ে নির্ভর করি। বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক—সব কিছুতেই রুমানার ওপর নির্ভর করা যায়। এই যেমন কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও তিনি ভূমিকা রাখলেন। আবার এশিয়ার দেশগুলোকেও তিনি ভালো বোঝেন। তিনি দেশের প্রতি খুবই অনুগত। বিশ্বাস আর দায়িত্বকে তিনি গুলিয়ে ফেলেন না। তিনি নতুন প্রজন্মের আমেরিকান মুসলমানদের জন্য নমুনা হাজির করছেন।
রুমানা বলেন…
ছোটবেলায়ই মা-বাবা আমাকে আমেরিকা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।  শিক্ষিত করেছেন ইসলামী শিক্ষায়ও। একবার আরিজোনার এক মসজিদের সামনে কিছু মানুষ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়েছিল এ জন্য যে বের হলেই মুসলমানদের হত্যা করবেন। কিন্তু সেদিন তারা সফল হয়নি। পর দিন মসজিদের ইমাম সাহেব ওই লোকদের মসজিদের ভেতরে আমন্ত্রণ জানান।  তাদের মধ্য থেকে একজন মসজিদে প্রবেশ করেন। তিনি ফিরে এসে তাঁর সঙ্গীদের বলেন, আমরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল বুঝে বসে আছি। আসলে ধৈর্য দিয়েই হিংসা মোকাবিলা করতে হয়। আমি নিজেও যখন সংকটে পড়ি, মহানবী (সা.)-এর জীবনী খুলে বসি। তিনি অনেক বাধা আর সমস্যা মোকাবিলা করেছেন ধৈর্য আর আন্তরিকতা দিয়ে।
মেয়েটা রুমানার মতো হোক
এভিয়েটর বা স্টার ট্রেকের অভিনেতা অ্যাডাম স্কটের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয় রুমানার। স্কট জিজ্ঞেস করেন, সাদা বাড়ি কেমন সামলাচ্ছো অথবা হিজাব দিয়ে চুলগুলো ঠিক ঢাকা পড়ছে তো? স্কট আরো বলেন, আমি চাই আমার মেয়েটা তোমার মতো হোক।
জো বাইডেনের সঙ্গে
দুই বছর আগে রুমানা ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মরক্কো গিয়েছিলেন। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের নারী উদ্যেক্তাদের নিয়ে তিনি সমাবেশ করেছিলেন। বিশ্ব মহিলা দিবস উদ্‌যাপনে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। তিনি কেনিয়ার এক নারী উদ্যোক্তার গল্প বলেছেন, তিনি একজন ধাত্রী। কেনিয়ার অধিকাংশ গর্ভবতী মা নিজ ঘরেই সন্তান প্রসব করেন। ধাত্রী নারী মায়েদের নিরাপদ প্রসবে কার্যকর কিছু হালকা ও পরিচ্ছন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু একবার তিনি সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেননি এক প্রসূতি মায়ের কাছে। যদিও মোবাইল আছে কেনিয়ার প্রায় সবার কাছে। তবু সমস্যাটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরে ধাত্রী একজন সফটওয়্যার ডেভেলপারের কাছে গিয়েছিলেন। ডেভেলপার তাঁকে একটি অ্যাপ তৈরি করে দেন, যা যোগাযোগের সমস্যা মেটাতে সাহায্য করে।  রুমানা বলেন, আমি নিজে ওই গল্পটি শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
সবারে বাসরে ভালো
মানুষ সে যেমনই হোক, ভালো ব্যবহার করো তার সঙ্গে—এই দর্শন রুমানার। রুমানা বলেন, মানুষ সে যে গোত্রের বা ধর্মেরই হোক, সম্মান জানানোর বিষয়টিই প্রথমে আসবে। আপনার হাসিমুখ পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।
রুমানার চিঠি
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
আজ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকার একটি মসজিদ পরিদর্শনে যাচ্ছেন। ব্যাপারটি আমার অনুভূতিতে নাড়া দিচ্ছে। মেরিল্যান্ডে আমি জন্মেছি এবং বড় হয়েছি। বাস্কেটবল আর শিল্পকলা আমার পছন্দের বিষয়। বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করতে ভালোবাসি। কিন্তু ৯/১১-এর বিশ্রী হামলার সময় আমি অষ্টম গ্রেডের ছাত্র ছিলাম। একজন মুসলমান হিসেবে দিনগুলো আমেরিকায় আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠল। স্কুলের সহপাঠীরাও অন্য রকমভাবে তাকাচ্ছিল। আমি যেন অভিশপ্ত কেউ! কোনো শিশুর পক্ষে সেটা বেশ ভারী ব্যাপার ছিল। তবে আজ পরিস্থিতি আলাদা। অন্যদের মতো আমিও একজন আমেরিকান। ধর্মের প্রতি আমার অনুরাগ, আমেরিকার মূল্যবোধ আমাকে সাহসী করেছে। আমি সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছন্দ এখন। হোয়াইটের ওয়েস্ট উইংয়ের দরজা ঠেলে ঢুকি যখন ভেবে আনন্দিত হই যে দেশকে নিজের দেশ ভাবি, সে দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় আমি ভূমিকা রাখছি।
আজকে যখন প্রেসিডেন্ট ওবামা বাল্টিমোর ইসলামিক সোসাইটিতে কথা বলবেন তখন আমিও থাকব শ্রোতার সারিতে। এই জনগোষ্ঠীকে অচ্ছুৎ ভাবা হয়েছিল। আজকের দিন মিলনের দিন হোক। গুটিকয় সন্ত্রাসীর সঙ্গে এত বিরাট জনগোষ্ঠীকে গুলিয়ে ফেলা না হোক। মুসলমানদের অনেকে এ দেশে শিশুদের শিক্ষা দেন, ডাক্তার হয়ে সেবা দেন, যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেশের হয়ে লড়াই করেন—এ কারণে আমি গর্বিত। কারণ আমিও মুসলমান।
আপনি যদি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন, নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন, আপনি সাফল্য পাবেন—কিছুই যায় আসে না আপনি কে আর কিভাবে প্রার্থনা করেন। আমাকে দেখুন, একদিন আমাকে সহপাঠীরাও ভেংচি কেটেছে। কিন্তু আমি তো স্বপ্নের দরজা খুলতে পেরেছি।
আপনাদের ধন্যবাদ।
রুমানা আহমেদ
অ্যাডভাইজার অ্যাট দ্য হোয়াইট হাউস

-কালের কন্ঠ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here