ভাবুন তো একবার, দেশি বা আন্তর্জাতিক কোনো পুরস্কার অনুষ্ঠানে আপনার প্রিয় তারকার পরনে রয়েছে খাদির তৈরি গাউন, স্কার্ট বা পাশ্চাত্য ঘরানার কোনো পোশাক। তাহলে কেমন হবে বলেন তো? খাদি দিয়েও যে এ ধরনের পোশাক বানানো যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত খাদি উৎসবে দেশ-বিদেশের ডিজাইনাররা তা করে দেখিয়েছেন৷ নানা রং, ঢং আর নকশার খাদি কাপড়ে তৈরি পোশাকগুলো প্রদর্শনী মাত করে দিয়েছিল। খাদি—স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই কাপড়ের এমন ভিন্ন উপস্থাপন অনেক ডিজাইনারকেই খাদি নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
একটু একটু করে শীত নামছে। আগে এ সময়টাতেই গায়ে জড়ানো হতো খদ্দরের শাল বা চাদর৷ এ ছাড়া ঈদের সময় হাতে গোনা কয়েকটি ফ্যাশন হাউসে দেখা যেত খাদির পোশাক৷ এখন চিত্রটা বদলেছে৷ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে খাদিতে যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন ভাবনা—জানালেন ডিজাইনার এমদাদ হক৷ খাদি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে—সিল্ক সুতার উচ্ছিষ্ট থেকে যে খাদি তৈরি হয়, তা অ্যান্ডি সিল্ক। আর সুতি সুতার উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি হয় সুতি খাদি৷ খাঁটি সুতি হওয়ার কারণে খাদি সহজেই ঘাম শুষে নেয়৷ কিন্তু বুননপদ্ধতির কারণেই বেশ মোটা হয়ে থাকে খাদির কাপড়৷ এ জন্য শীত ছাড়া অন্য সময় খাদির ব্যবহার ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি৷
এখনকার কথা ভিন্ন। খাদি শুধু শীতের সময় পরতে হবে, এখন এ ধারা নেই। ডিজাইনার লিপি খন্দকার জানালেন, নকশাবিদদের গবেষণায় এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন গরমকালে পরার উপযোগী খাদি কাপড় তৈরি হচ্ছে দেশে৷ সুতার বুননে তো আছেই, তা ছাড়া রং করেও (ডাই) এখন খাদির জমিনে আনা হয় নতুনত্ব৷ এদিকে যার হাতের বুনন যত সুন্দর হবে, তাতে খাদি কাপড় হয়ে উঠবে আরও বেশি টেকসই ও আকর্ষণীয়৷
খাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরবময় এক অধ্যায়৷ স্বদেশি আন্দোলনের সময় বর্জন করা হয়েছিল মিলে তৈরি কাপড়৷ সেই সময় চরকায় হাতে কাটা সুতা দিয়ে তৈরি কাপড় পরাই ছিল দেশপ্রেমের প্রতীক৷ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় পুরো ভারতবর্ষে এই খদ্দরকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ খাদি হয়ে উঠেছিল দেশপ্রেমের প্রতীক।
বাংলাদেশে শৈলেন গুহর হাত ধরে প্রসারিত হয় খাদির বাজার৷ চট্টগ্রাম থেকে এসে কুমিল্লার চান্দিনায় তিনি গড়ে তোলেন খাদির কাপড় তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণ খাদি’৷ এরপর নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমে তৈরি হয় খাদি৷ একটা সময় এসে খাদি হারিয়ে ফেলেছিল তার পুরোনো ঐতিহ্য৷ একটু একটু করে নিভে যাওয়া খাদির শিখাটা জ্বলতে থাকে শুধু গ্রামীণ খাদিতে৷ নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যখন জমে ওঠে দেশীয় পোশাকের বাজার, সেই সময় দেশীয় কাপড় নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন নকশাবিদ কাজ করতে শুরু করলেন খাদি নিয়ে৷ বিদেশের মাটিতেও তাঁরা তুলে ধরলেন দেশীয় খাদির ঐতিহ্য।
তারপরও খাদির বাজারের তেমন সম্প্রসারণ হয়নি৷ ডিজাইনাররা মনে করেন, খাদি সব সময় পরার উপযোগী হয়ে উঠতে না পারাটাই এর কারণ৷ এ প্রসঙ্গে ডিজাইনার শৈবাল সাহা জানালেন, কাটুরিরা (যারা সুতা কেটে চরকায় কাপড় বোনে) তাদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে খাদি তৈরির প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন৷ বছরজুড়েই যদি খাদি কাপড় তৈরি করা যায়, তাহলেই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে জানান তিনি৷ বিষয়টি একসময় দেশীয় পোশাক নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের বেশ ভাবিয়ে তোলে৷
১৯৮৬ সাল থেকে খাদি নিয়ে কাজ করছেন ডিজাইনার মাহিন খান৷ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, খাদি তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি পরিবেশবান্ধব৷ সুতা তৈরি থেকে শুরু করে কাপড়ের বুননের পুরো প্রক্রিয়াটিই হাতে হয়ে থাকে৷ এতে কোনো বিদ্যুৎ খরচও হয় না। তিনি বললেন, ‘বর্তমানে বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব পোশাকের যে স্লোগান উঠেছে, সেখানে একটা বিশাল জায়গা করে নিতে পারে খাদি৷ সুতার কারণে খাদি কাপড়টা বেশ মোটা হয়ে থাকে৷ ভালো মানের সুতা হলে কাপড়ের বুননটাও হবে মিহি ও মসৃণ৷ এখন সেই কাজটিই করে যাচ্ছে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ৷’ শুধু ভালো মানের কাপড় তৈরিই নয়, পাশাপাশি খাদির তৈরি পোশাক বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে চান তাঁরা৷
খাদি উৎসব
ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো খাদি উৎসবের আয়োজন করছে৷ ৯ ও ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলে চলবে এই খাদি উৎসব৷ উৎসবে বাংলাদেশের ১৭ জন ডিজাইনার অংশ নেবেন৷ পাশাপাশি ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালয়েশিয়া থেকেও আসবেন ডিজাইনারা৷ এরপর ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর গুলশানের গার্ডেনিয়া মিলনায়তনে দুদিনব্যাপী খাদি শোর পোশাক প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷
খাদির ঠিকানা
চট্টগ্রামের পটিয়ার ছেলে ছিলেন শৈলেন গুহ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে মিরসরাইয়ে তৈরি হতে শুরু করে খাদি কাপড়৷ সেই সময় উপেন বক্সের বিদ্যাশ্রম থেকে রঙের কাজ শেখেন শৈলেন গুহ৷ তাঁতিদের কাছ থেকে খদ্দর কাপড় কিনে তাতে রং করতেন তিনি৷ এরপর কুমিল্লার চান্দিনায় প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ খাদি৷ সেই থেকে খাদির ঠিকানা হয়ে গেল চান্দিনা।
বাবা শৈলেন গুহর মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন তাঁর ছেলে অরুণ গুহ৷ চলতি বছরের ২০ এপ্রিল মারা যান তিনি৷ বাবা শৈলেন গুহর কাছ থেকে খাদি কাপড় তৈরির যত কৌশল আছে, তা শিখেছিলেন অরুণ গুহ। ডাইং অর্থাৎ রং করার কাজেও তিনি ছিলেন দক্ষ৷ শুধু খাদি উৎপাদনেই নয়, খাদিকে বাজারজাত করার পেছনে তাঁর ছিল বিশেষ ভূমিকা৷ এ ছাড়া খাদি উৎপাদনের কাজে অনেক দরিদ্র নারীকে যুক্ত করেন তিনি৷
আসল খাদির আরেক ঠিকানা গান্ধী আশ্রম। নোয়াখারীর সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগ গ্রামে এই গান্ধী আশ্রমে তৈরি হচ্ছে খাদি।
কৃতজ্ঞতায়: প্রথমআলো