প্রচ্ছদ সাহিত্য অনন্য সুফি কবি আমির খসরু

অনন্য সুফি কবি আমির খসরু

0
আফতাব চৌধুরী: মার্গসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ আসরে ভারতীয় সঙ্গীতের বিশেষ সুরবন্ধ গাওয়া হয়, যাকে বলা হয় ‘তারানা’। এটি একটি ঐতিহ্য। যার মানে শ্রোতাদের সুর ও আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি বিশিষ্ট সুফি কবি খসরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। যাঁকে শুধু সুফি বা সন্ত কবি হিসেবে গণ্য না করে অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রতিভাধর হিসেবে মান্য করা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে তাঁর আবিষ্কার ‘সেতার’ এবং ‘তবলা’ নামক দু’টি বাদ্যযন্ত্রের জন্যও স্মরণ করা হয় তাঁকে। আসলে প্রাচীন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ঢোল ও বীণা থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর খসরু সেতার ও তবলা সৃষ্টি করেন।
খসরু লিখিত সুফি ভক্তিগীতিগুলোতে যে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুফি রহস্যময়তা ফুটে উঠেছে, সেটা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা। সে ভালোবাসার অর্থ হচ্ছে পরমাত্মার সাথে ভক্তের চিরন্তন বন্ধন। এসব ভক্তিগীতি ‘কাওয়ালি’ নামে জনপ্রিয়। শ্রোতাদের হৃদয়ে পরমানন্দের ভাব জাগরিত করে এগুলোর বিষয়বস্তু ও গায়কী ঢঙ।
একটি কবিতায় অনেক কাব্যিক অনুভবসমৃদ্ধ শব্দ রয়েছে। সুফি ধর্মমতের রহস্যময়তার নির্গলিতার্থ হচ্ছে ভক্তহৃদয়ের গভীর ব্যক্তিক অনুভূতির প্রকাশ। সৃষ্টিকর্তার রহস্যময় অনুভব তথা অভিজ্ঞতার কথা-
আমার জনা নেই সেটি স্থান?
যেখানে রাত কাবার করেছি আমি,
আমার চার পাশে শুধু অসংখ্য শরীর,
আধা জবাই করা মানুষের তীব্র যাতনায়
কুঁকড়ে যাওয়া নাচ প্রিয় সুন্দরী প্রেয়সী তরুণীও ছিল।
তার শরীর, একটি ঝাউগাছ
টিউলিপের মতো রাঙা তার মুখ,
প্রতিটি হৃদয়ের গভীরে নির্মম বেদরদি ধ্বংসলীলা,
স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার তাঁর এই উৎসবের মালিক
অন্য পৃথিবীর এই উৎসবের মহম্মদ
আলোক শিখা ঊর্ধ্বে তুলে আলোকিত করেন উৎসবস্থল
যেখানে আমি রাত কাটিয়েছি শুধুই কাটানো।
শুধু প্রেয়সীর কথা ভেবে ভেবে॥
হৃদয়ে উষ্ণতা জাগানো কবিতায় খসরু আশাবাদের একটি রঙিন ছবি এঁকেছেন একজন আত্মোৎসর্গকারী প্রেমিকের চোখে। কোনো মোমের আলোই চাঁদের আলোর চেয়ে ভালো নয় অন্ধকার রাতে একজন ভিখিরির পর্ণকুটির আলোকিত করার জন্য।
উত্তর প্রদেশের গঙ্গাতীরে পাতিয়ালি শহরে ১২৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন খসরু। তাঁর বাবা সৈফুদ্দিন ছিলেন এক তুর্কি এবং বিশিষ্ট মানুষ। দিল্লির সালতানাত সুলতান বলবনের শাসনামলে তিনি এক সেনাদলের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন। খসরুর আট বছর বয়সে তাঁর বাবা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। তাঁর মা তারপর তাঁকে নিয়ে দিল্লি চলে আসেন। সেখানে তাঁকে পরম মমতায় মানুষ করে তোলেন খসরুর দাদা (বাবার বাবা)।
জন্মের সময় খসরুর নাম ছিল আবুল হাসান ইয়ামিনুদ্দিন। যৌবনে কবিতা লিখতে শুরু করে ছদ্মনাম গ্রহণ করেন খসরু। খসরু দিল্লির অন্তত সাতজন সুলতানের সভাসদ এবং কবি হিসেবে কাজ করেছেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অনেক ঘটনা এবং তরবারি সংস্কৃতির কবল থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার জন্য। তবে যখনই যেকোনো শাসকের বিশ্বাস অর্জন করেছেন তিনি, তার জন্য তাঁর সম্বল ছিল নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা।
দেখা যাচ্ছে, খসরু সেই প্রবাদবাক্যটি অনুসরণ করে চলতেন, ‘সিজারের প্রাপ্য সিজারকে সমর্পণ করো, সৃষ্টিকর্তার জন্য যা প্রাপ্য তা সৃষ্টিকর্তাকেই দাও।’ দরবারের সদস্যরা এবং শাসকদের সাথে যতই সুসম্পর্ক থাকুত, খসরু একবারের জন্যও একজন সুফি আধ্যাত্মিক কবির ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হননি। বিচ্যুত হননি চিরন্তন অধ্যাত্ম সম্পর্ক থেকে সৃষ্টিকর্তার সাথে এবং সব মানুষকে ভালোবাসার ঐকান্তিকতা থেকে।
হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রিয় শিষ্য হিসেবে খসরুর অন্তরে আধ্যাত্মিকতার ধারণাটি গঠন করে দিয়েছিলেন। নিজামুদ্দিনকে দিল্লির পৃষ্ঠপোষক সন্ত হিসেবে অভিহিত করা হয়। সম্রাটের প্রতি আনুগত্য দেখানোর সময় খসরুর মনে সর্বপ্রথমে থাকত তাঁর স্বদেশ তথা মাতৃভূমি ভারতের প্রতি শ্রদ্ধা ও অপার ভালোবাসা।
তাঁকে ভারতের প্রথম জাতীয় কবি বলা যায়। তা ছাড়া সন্ত কবীর, গুরু নানক প্রমুখ সাধু-সন্ত এবং মহান ধর্মগুরুদের বাণী তথা ধর্ম প্রচারের আগে প্রতি ভালোবাসা, মানবতার পক্ষে ভালোবাসা, সব ধর্ম সমন্বয় ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের জাগরণ বন্ধুত্ববাদী সমাজ গঠনের মর্মবাণী প্রচার করেছিলেন তিনি।
ভারতের আধ্যাত্মিকতা এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে ভালোবেসেছেন খসরু। প্রাচীন হিন্দুদর্শন, সভ্যতা, ভাষা, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আধার তথা আকর প্রাচীন বেদের প্রশংসাও করেছেন তিনি। প্রাচীন ভারতে ওষুধ, দর্শন, অঙ্ক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে হিন্দুদের অবদানের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
অভিনব শূন্য আবিষ্কারের জন্য খসরু ভারতীয়দের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। তিনি আরো স্বীকার করেছেন যে, আরবি শব্দ ‘হিন্দসা’ অঙ্কে সংখ্যাতত্ত্বের বিষয় বোঝায়, এটা উৎপন্ন হয়েছে ভারতে। আরবি ও ফারসি ছাড়াও অন্যান্য অনেক ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন। হিন্দিতেও অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি। এটাকে তিনি বলতেন ‘হিন্দাবি’।
দিল্লির বাসিন্দাদের এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সৌজন্যবোধ ও আচরণের প্রশংসা করেছেন খসরু এবং তাদের মার্জিত রুচি ও ভালো ব্যবহারের সাথে স্বর্গের বাসিন্দাদের আচরণের তুলনা করেছেন। এ দেশের ঋতুবৈচিত্র্যের তুলনা করা যায় না। ভারতের গ্রীষ্মকালকে শুধু পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সহনীয় গরমের সাথে তুলনা করা যেতে পারে বলেও লিখেছেন খসরু। বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন, আকাশ ঢেকে যায় পানিভরা মেঘে, সবুজের মেলা বসে আছে। সবখানে নয়নাভিরাম পুষ্পসম্ভার সেই সবুজের মেলায়। সুস্বাদু ফলেরও কত আয়োজন। ভারতের বৃক্ষলতা ও জীববৈচিত্র্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, বৃষ্টির পানিভরা সরোবরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাঁসের দল- এর চেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার আর কী হতে পারে। নানা বর্ণে রঞ্জিত ময়ূর-ময়ূরী দেখে আনন্দে আত্মহারা খসরু বলেছিলেন, ময়ূরের মতো এমন সুন্দর পাখি যে দেশে জন্মায়, সে দেশকে স্বর্গ ছাড়া আর কী বলা যায়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here