মো: আবদুস সালিম: ক্রেসিডা ডিক। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন সারা বিশ্বে। সম্প্রতি কর্মঠ ও সাহসী এই নারীকে লন্ডন পুলিশের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। লন্ডন পুলিশের প্রায় ১৮৮ বছরের ইতিহাসে ডিকই প্রথম নারীপ্রধান। এর আগে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন পাঁচ বছর। দায়িত্ব পাওয়ার পর ক্রেসিডা ডিক বলেছেন, এমনই একটি দায়িত্ব পাওয়ার আশা আমার ছিল দীর্ঘ দিনের। সেই আশা পূর্ণ হলো। এটি একটি অসাধারণ সুযোগও, যা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এত বিশাল দায়িত্ব পেয়ে আমি সম্মানিত বোধ করছি। এটি একটি মহান দায়িত্বও।
কনস্টেবল পদে যোগ দেন (স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে) ১৯৮৩ সালে। তিনি লন্ডন ও অক্সফোর্ড পুলিশের বিভিন্ন পদেও সফল দায়িত্ব পালন করেন। আর পররাষ্ট্র বিভাগে যোগ দেন ২০১৫ সালে। দায়িত্ব বাড়া মানে আগের চেয়ে বেশি কাজ করা। এখন তাকে সামলাতে হবে লন্ডন পুলিশের ৪২ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। আর অন্যান্য কাজ তো রয়েছেই। অনেক চাপের মধ্যেও ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করার গৌরব অর্জন করেন। অপারেশন ট্রাইডেন্ট পরিচালনা করতেন অস্ত্রধারী অপরাধীদের ব্যাপারে। ব্রিটেনের বৃহত্তম পুলিশবাহিনীকে সংস্কারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ক্রেসিডা ডিক। তাই তাকে মোকাবেলা করতে হবে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জকে।
তিনি খুবই নমনীয় ছিলেন এই গুরুদায়িত্ব পছন্দের ব্যাপারে। এ পদে কাজ করে তিনি প্রতি বছর মজুরি পাবেন দুই লাখ ৭০ হাজার পাউন্ড। চাকরির জন্য চারজন প্রার্থীর মধ্যে রাজধানীকে নিরাপদ রাখার ব্যাপারে দু’টি সাক্ষাৎকারে ডিকই সবচেয়ে সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। কাজের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে হয় বলেও মন্তব্য করেন এই কমিশনার। তিনি আরো বলেন, কোনো বিভাগে সর্বোচ্চ পদে কাজ করা মানে সব ধরনের চ্যালেঞ্জে যাওয়ার মানসিকতা থাকা। ডিকের এই নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ।
ইউকের পুলিশ বাহিনীতে শীর্ষ পদে বসে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে শুরু হয়েছে। বিশেষ করে অতিমাত্রায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ভয়ভীতি, জাল জালিয়াতি, সাইবার অপরাধ ইত্যাদি কমবেশি বৃদ্ধির কারণে প্রায় সর্বক্ষণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে। সামনে আরো যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে তা হলো দুর্বলকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সবল হাতে রক্ষা করা, যৌন হয়রানির শিকার এবং পারিবারিক দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো।
বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন, লন্ডন ও ইউকেতে একবিংশ শতাব্দীতে অপরাধের ধরন পরিবর্তনের সাথে সাথে ডিকের কাজের নৈপুণ্যতা ও অন্তর্দৃষ্টি মহানগর পুলিশকে তাদের কাজের ক্ষেত্রে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করবে। থেরেসা মে বলেন, মহানগর পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য যে বিশেষ গুণাবলি দরকার তা ডিকের আছে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, তার কর্ম নৈপুণ্যতা ও অন্তর্দৃষ্টি পুলিশ বিভাগ সংস্করণে এবং চলমান সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে জাতীয় সাড়া সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এক কথায়, দুর্বলকে রক্ষার যে দায়িত্ব পুলিশ বহন করে তার সমর্থক হচ্ছেন ডিকে। তার দীর্ঘ ও খ্যাতিমান ক্যারিয়ার তার কাজের মধ্যেই প্রতীয়মান হয়। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান ডিককে চিহ্নিত করেন পুলিশ কমিশনার হিসেবে একজন পছন্দের ব্যক্তি। খান বলেন, ‘ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় দিন যে, আগত দিনের জন্য কমিশনার হিসেবে যে একজন আইকন খুঁজছিলাম তা আমরা পেয়েছি। এবং আমরা সার্থক।
নিয়োগ পরীক্ষায় ডিককে দীর্ঘ সাইকো মেট্রিক (মনোবিদ্যার মাপকাঠি) ও কঠোর মৌখিক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। সন্ত্রাসবিরোধী প্রধান হিসেবে মহানগর পুলিশের প্রতিযোগিতারও সম্মুখীন হতে হয়। এই পরীক্ষায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সহকারী কমিশনার মার্ক মাউলে। সাবেক কমিশনার লর্ড ব্লেয়ারের খুবই আস্থাভাজন ছিলেন ডিক। তার পূর্ববর্তী প্রতিটি পুলিশপ্রধানের মতো তিনিও বিট অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১২ সালে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার সময় অপরাধ প্রতিরোধ পুলিশ টিমের প্রধান ছিলেন। এর আগেও তিনি ফোন হ্যাক করা ও অফিসারদের ঘুষ গ্রহণের তদন্তেও দায়িত্ব পালন করেন। তার নিয়োগ বলতে বোঝায় অপরাধীদের বিচারব্যবস্থায় পাঁচটি পদের সমান গুরুত্ব বহন করা। যেসব পদ বর্তমানে নারীরা ধারণ করেছেন ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে। ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির মহাপরিচালক লিনে ওনস আত্মমর্যাদা রক্ষার তাগিদে ডিকের সাথে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিচারব্যবস্থায় যে দু’জন নারী রুড ওং থরন্টন ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসে নিয়ন্ত্রক ছিলেন, তারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
একসময়ে ডিক উত্তর আয়ারল্যান্ডে পুলিশ বিভাগে চাকরির আবেদন করে ব্যর্থ হন। তাতে তিনি দমে যাননি। পরে ফরেন অফিসে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ডিক কমিশনারের দাফতরিক ক্ষমতা পান। পুলিশে চাকরির আগে তিনি একটি বৃহৎ হিসাব ও নিরীক্ষা ফার্মে কাজ করেন। ইস্ট অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপকও ছিলেন তিনি। এতে দেখা যায় নানা ক্ষেত্রে কাজে তার রয়েছে প্রচুর অভিজ্ঞতা।
ব্রিটিশ এই শীর্ষ কর্মকর্তার জন্ম ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। শিক্ষাজীবন শুরু করেন ড্রাগন স্কুল, অক্সফোর্ড হাইস্কুলে। ক্যামব্রিজের বালিয়ল কলেজ, অক্সফোর্ড ফিজউইলিয়াম কলেজেও পড়াশোনা করেন। পুলিশ বিভাগে ক্রেসিডা ডিকের সর্বোচ্চ পদ হলেও বয়সের কারণে এই বিভাগই হয়তো তার কর্মজীবনের ইতি টানতে হবে।