প্রচ্ছদ সাহিত্য ঘের

ঘের

0
নাহার মনিকা

দিনের সাথে রাতের মাতব্বরীর কত তফাৎ! তাদের সঙ্গে হামিদের বউয়ের পরিচয় মাত্র মাসখানেকের। কবুল বলার পরের দিন থেকে সদ্য সদ্য গজানো ওলকপির মত কত কিছু ঘটে যাচ্ছিলো তার দৈনন্দিনে, তিতির পাখির বিষ্ময় অচেনা বিভ্রম হয়ে তাকে থই থই পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো রােজ। কিন্তু এখনকার এই খচখচানি অস্বস্তির সঙ্গে সে সবের কােন মিল নেই। একরত্তি বালি চােখের ভেতর অস্ত্রসমেত সারারাত খচখচ করে। এখন হামিদের বউয়ের ইচ্ছে হয় চােখের ওপর দিয়ে একটা হাতি পিষে দিয়ে যাক, চােখের মণিটা পচা আঙ্গুরের মত থেবড়ে থাকুক বালি ভরা নদীর চরে। চােখ দুটোই বুঝি বালি, সব কান্না শুষে নেয়, বালিই যদি হবি তাে বালিতেই নিপাত যা।

এল প্যাটার্ণের চারটা ঘরের দুটোর গায়ে এখনো কংকালের মত শুধু ইট সিমেন্টের আড়াল। দরজা জানালা খােলা ফােকর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে থাকলেও ঘরের মাঝখানে ইতস্তত গজিয়ে ওঠা সরষেফুলের হলুদ উদ্ভাস সে খিঁচুনিকে স্মিতহাস্য বানিয়ে দিতে চায়। লাগোয়া দুটো দেয়ালে শাদা চুনকাম, কাঠের দরজা জানালা তাদের মজবুত পেশী প্রদর্শন করে, সেখানে হামিদের বৌ নিজেকে নিরাপদ ভাবে, তারপরও দেয়ালের বাইরের আলোছায়া তাকে ঈশারা দেয় ডাকে। ভেতর থেকে খিল ঠেলে দিলে জানালার দু পাল্লা আপনিই খুলে যায় আর গলগলিয়ে কুয়াশা মাখা শীত চালাক চােরের চালে ঢুকে পড়ে ঘরে। জানালায় হামিদের বৌ আর তার সঙ্গে লেপ্টে থাকা আধ জাগা রাত আর তার না ঘুমানো চােখের পাতা চারদিকে আবছা অন্ধকারের ভারী বাটখারা হয়ে চেপে থাকে। বৌটার খােলা আর বন্ধ চােখের সামনে নৃত্যরত সেইসব অবাধ্য দৃশ্য সারাটা রাত তাকে টেনে হিঁচড়ে কাদাময় মাটিতে শুইয়ে ফেলে। আর ঝাঁকি খাওয়া লজ্জাবতী গাছের মত চােখের পাতা আর বােজে না। যদিও নিয়ম নেই, তবু যেখানে ঘটনার শেষ হয় সেইখানে দৃশ্যের শুরু। নিরুদ্দিষ্ট ঘাতকের কথা ম্যাচের কাঠে জ্বালানোর গন্ধ ছােটায় আশেপাশে। হাত ছোঁয়া দূরত্বে পাশের বাড়ির টেলিভিশনের ছােট্টপর্দ্দায় ”ঘাতকের সহযোগীরা এখনো পলাতক অথবা লাগাতার হুমকি দিয়ে চলছে’- রিপোর্টারের মিহি কন্ঠে পাশের ঘর থেকে এসে টেবিলের এককোনে পড়ে থাকা মুড়ির বাটিতে, মাখানো তেলের রসায়নিক আস্তর ভেদ করে ময়াল গতির সঙ্গে মুড়িগুলোকে নাস্তানাবুদ করে ফুলতে ফুলতে নেতিয়ে যায়। সামনের রম্বস টেবিল ক্লথে রঙ্গিন স্মৃতিজারিত সূতা ফুলের কলির বাড়ানো ডাঁটা সমেত জানলার দিকে ধাবমান। জানলার ওপাশে শিশু শুপারি গাছের গায়ে ফুস্কুরির মত মৃদু শিশির, পাতাগুলো এখনো ধরা ছােয়ার মধ্যে। হামিদের বৌ বিছানায় বসে থেকেই হাত বাড়িয়ে তা স্পর্শ করে। তার গােলগাল হলুদ বরণ হাত আদেখা আলোয় ভরে যায়, সেখানে মেহেদীর ফ্যাকাশে রং, আর তার চােখের পাতায় প্রথম বর্ষার মত ব্যাকুল পানির ফােটা। ঘুম ভাঙ্গা চােখে কান্না সময় নিয়ে আসে, আর এসে সহজে সরতে চায় না। জানলার অসমান কাঠের ফ্রেমের পের এক দঙ্গল কাঠপোকার বিষন্ন মিছিলকে দুভাগ করে আবারো টেলিভিশনের বিস্ফরিত ঘাের উন্মাতাল বাজনায় মহল্লা জেগে ওঠেকােন রুপবতী নারী তার সরু কােমর দুলিয়ে নাচে… এই সংবাদের সঙ্গে অতলান্ত ধাতব বাজনা এবড়ো থেবড়ো দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠতে থাকলে হামিদের বৌ লেপের তলা থেকে ধীরে ধীরে ওঠে। পরনের সূতীর জামা পিঠের কাছে টেনে সােজা করে। তার দীঘল শ্যাম অঙ্গ, অল্প বোঁচা আর একটু আবেগেই ঘেমে ওঠে নাক বারবার সিঁথি মাথার পেছনে সােজা এক পথ তৈরী করে যেখানে তার বাসনারা পৌঁছে যেতে চায়। সূতি কাপড়ের ওড়নাতে চুমকির চকমকি করে মাথা আর কাপড়ে কয়েক দফা ধ্বস্তাধ্বস্তি শেষে অবাধ্য শিশুর মত গােজ হয়ে বসে। হামিদের বৌ তারপর অকারণে আবার ঘােমটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের কাছে যায়। বার্নিশ করা মসৃণ কাঠের টুলে বসে। তাদের বাড়ির পূর্বদিকের বয়সী কাঠাল গাছ, কােটরের খাঁজ গভীর আর চােয়াড়ে, যেন বয়সের সাথে লড়াই করার প্রস্তুতি। তাই হয়তো করতে হয়- নতুন মাটি, নদী, ঢেউ, বন্যা কত কি’র সঙ্গে টিকে থাকার অনলস প্রস্তুতি। কাঠাল মােটা নীচু ডাল সেখানে বৌটার কিশোর বেলা, পুরানো দড়ির বাঁধন, ততোধিক পুরোনো পিঁড়ি, সে বসে দেেল খায়। সেই ডাল দিয়ে হয়তো এই টুলের পায়া তৈরী! এই টুলে বসে এখন তার নাগরদোলা নাগরদোলা লাগে। করাতিদের ক্ক-ঝা, ক্ক-ঝা শব্দের মধ্যে কাঠাল গাছটা, ভারসাম্যহীন টলে টলে আগায়, মাঝ বরাবর ছিবড়ের দড়ির কাছে আত্মসমর্পণ করে ধীরে ধীরে মাটিতে শােয়, আর মানুষজন কামলাদের শােরগোল বেশী আওয়াজ তােলে। কাঠাল গাছ তখন চিত্রার্পিত নারী, নিজেকে নগ্ন বিছিয়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিল হয়, বক্স খাট হয়। তবে ডাইনিং টেবিলে মনে হয় কিছু ভুজুং ভাজুং পড়ে, আম অথবা অন্য কিছু। বিয়ের সময়কার কথাবার্তা দুই এক কান পার হয়ে এসে হামিদের বৌয়ের স্মৃতিতে ভালো করে গুছিয়ে বসতে পারে না।

সে সুতরাং বেখেয়ালে লম্বা হয়ে ওঠা চুল আঁচড়াতে বসে, আবার ঘােমটা যথাস্থানে। গত তিন চার দিনে এই প্রথম নিজের চর্চা। তারপর লেপকাঁথা ভাঁজ, বিছানা পরিপাটি, যেন জীবনের পরত পরত সাজিয়ে রাখতে পারা, দরকার নাই কিন্তু তার করারও তাে কিছু নাই।, ঘটনাটা সবাইকে ব্যতিসমস্ত করে রেখেছে। সে এই ঘটনার সঙ্গে নিজেরে সম্পৃক্ততা শতকরা ভাগ বুঝতে চায় আর সে বােঝাটা অন্য সবাইকে বােঝানোও যদি যেত! মুড়ির বাটিতে করুণামাখা দৃষ্টি দিয়ে সে তার মােবাইল ফােন চার্জার থেকে খুলে নিয়ে খাটে উঠে বসলে চারপাশের সময়ে অতিক্রান্ত এক মাত্রা ভর করে। তার ফােনে সেভ করা নাম্বারগুলো খুঁটিয়ে দেখে। হামিদের নম্বারটা সবার আগে, কেননা এটা তারই, ঘটনার অমোঘ জের হিসেবে সে উপহৃত হয়েছে। একটা টেলিভিশনের শখ ছিল তার। ঘরের বৌ ঝি’র চরিত্র নষ্ট হবে- গৃহস্থ বাপ কেন শাশুড়ির এই নিষেধাজ্ঞা না শুনে একটা টেলিভিশন সেট উপহার দিলো না এ আক্ষেপ আজকে তার দীর্ঘশ্বাসে রুপান্তরিত হয়।

সকালে কি এক পাখি খামোখা ডাকে আর ডাকে, নরম রােদে চৌকানা উঠানে ঘুরে বেড়ানো মনমরা বেড়াল ধুম চাঙ্গা হয়, হয়ে দৌড় দেয় ছাদের সিঁড়িতে। বাড়িটাকে দােতলা বানানোর খায়েশ সিঁড়ির আঞ্জাম আছে, খড়ে মােড়া প্রতিমা কাঠামোর মত শুধু কাঠ আর বাঁশ লাগানো, তা দিয়ে ছাদেও ওঠা যায়। হামিদের বৌয়ের ইচ্ছে হয় উর্ধ্বমুখী কােথাও যায়। ছাদ, একপ্রকার ওপরই তাে। হাতলবিহীন সিঁড়ি, অনভ্যাসে তার পায়ের পাতা শির শির করে। ছাদে দড়ির খাটিয়া, খানিকটা মাটি ঢিবি করে লাইগাছ বােনা,কয়েকটা চারা মাটির সঙ্গে কথা কয়, তাদের গােড়ায় ভেজা বিনীত লাল মাটি। রঙিন কাপড় নিংড়িয়ে থাকবে কেউ। নিজের সঙ্গে রঙিন চুপসে থাকা কাপড়ের মিল খুঁজে পায় হামিদের বৌ। ছাদ থেকে শুপারি গাছের ঝাঁকড়া মাথা দেখা যায় তার হাত বােলাতে ইচ্ছে করে, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছের শেকড় বেয়ে কান্নার বন্যাতোড় আসার আগে কেউ তাকে নাম ধরে ডাকে, সেই ডাক ক্রমশ দৈর্ঘ্যে বাড়ার আগেই গাছ বেয়ে সড় সড় করে নিচে নেমে যাওয়ার তুচ্ছ সাধ পাশে ঠেলে দিতে হয়।
দুই।

শাশুড়ীকে রাজী করাতে বেগ পেতে হলো না। ভরা যৌবনবতী ছেলের বৌকে জনসমক্ষে আনবে কি না তা নিয়ে হামিদের মায়ের দ্বিধা নাকি কেনি ব্যবসাদার মনোভাব সেসব অনুল্লেখ্য কারণ নিয়ে ঘাটা ঘাটি করার সময়ই বা রিপোর্টার মেয়েটির কােথায়? মানুষ নিজের চেহারা দেখতে আয়নার সামনেই দিন পার করতে পারে আর এটা টেলিভিশন। রাজী হবে না মানে তারপরও বুড়ির কথা মাথায় রেখে, ’কচি মেয়ে, বিয়ে হয়া সারতে পারল না, এমন হয়া গেলো’— তার বিলাপও মাথায় জায়গা করে নেয়, ” আমি এর বিচার চাই, আমার ছেইলে মাইনষরে সেবা করতে চাইছে, কত কম বয়সে চেরম্যান হইছেলো, আমার মানিকরে আমার কাছে ফিরায়া দেও”…।

বৃষ্টির দিনে ঢাকার বাইরে আসাই হুজ্জত। সেই গাড়ি থেকে নামো, প্যান্টের পা গােটাও। কালো গােল বড় টিপ লাগানো সাংবাদিক মেয়েটি তার জিন্সের ভাঁজ করা পা খুলে সােজা করে, তাকে রােয়া ফােলানো ডেকি মুরগীর মত লাগে, ইতি উত তাঁকিয়ে দৌড় ঝাঁপ করার জন্য তৈরী। ক্যামেরা জুৎ করে ষ্ট্যান্ডের ওপর বসে আছে। ক্যামেরাম্যান টুপি খুলে রাখলে তার হাফ টাক নিয়ে অল্প হাসাহাসি করারও জাে হয় না। মাত্র তিন জনের টিম নিয়ে একদূরে আসা ঠিক না। অন্তত আরো দুজন সহকারী দরকার। দেখোনা এখন এই বাড়ির বাউন্ডারি পর্যন্ত ভীড় উপচে পড়ছে। শিবচরে হামিদ চেয়ারম্যানের ভােট আছে, বিয়েটাও কি সেজন্যেই করা? মেয়েটার বাপের ফ্যামিলিতেই নাকি জন পঞ্চাশেক! সেই পুরনো সম্রাট আকবরীয় রাজনীতি- বিবাহের মাধ্যমে রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন? ইাহ! রিপোর্টার মেয়েটি মনে মনে হাসে, এখন রাজনীতির জটিলতা আর নিষ্ঠরতা ভিন্ন মাত্রার। তবে এই ভীড়ের মধ্যে নাকি শিবচরের বাসিন্দা বেশী, হামিদের মায়ের ইনফরমেশন। শিবচরের মেয়েটির চেয়ারম্যানের সাথে বিয়েই হয়তো একটা ঘটনা, আর এখন এমন খবরে পাব্লিক ইনভলভ্ড হবে এটাই স্বাভাবিক। সরে জমিনে জুতে যাবার মত ঘটনা এদেশে কম না কিন্তু মফস্ফলে টিলিভিশন ক্যামেরার আগমন দুই চারটা জাতীয় দিবস বা নেতা নেত্রীর ভিজিট বাদ দিলে তেমন বেশীও তাে না। মানুষ জন করবেই বা কি টেলিভিশনের ক্যামরা বলে কথা! আর সবাই ঘটনাও বুঝতে চায়, জানতে চায় ভেতরের খবর। কিন্তু এখন এই ভীড় সামলাতে বাড়তি একজন দরকার। নতুন চ্যানেল হলে যা হয়। পয়সা বাঁচানোর ধান্ধা মালিকের আর জানবাজি রেখে কাজ করার বাসনা রিপোর্টারদের। কয়েকটা আকর্ষনীয় নিউজ ফিড দিতে পারলে আর পায় কে? তখন নিজের দর বাড়াও, বাড়তি সম্ভাবনার কথা চিন্তা করো!

উঠানময় থক থক কাদা মানুষের পায়ে পায়ে পিষে গিয়ে শক্ত হচ্ছে। একবার ক্যমরা সরিয়ে নতুন দেয়াল ওঠা খড়খড়ে কাঠামোর ভেতরে নিতে বলে আবার মক বদলে উঠানেই রাখতে বলে, কাদার মধ্যে ষ্ট্যান্ডের তিন পা মুখ থুবড়ে থাকে। অন্যদিক জানলা- দরজাবিহীন ঘরের মেঝেতে গজিয়ে ওঠা ইতস্তত শরষে ফুলের হলুদে ক্যামেরা ঘুরে আসে এক চক্কর। বারান্দায় হাঁটু গুজে বসে বৌটা সেদিকে তাঁকিয়ে আছে, হয়তো ঘরের ভেতর গাছ গজানোর মাজেজা চিন্তা করে। কে এখানে ছিটিয়েছিলো শরষে দানা? কােন ভুত ছাড়াতে? তাকে কেউ একজন ডেকে ঘরে নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে চায়। সাংবাদিক মেয়েটি নিষেধ করে, থাক, শােকের আবহটাই সে ধরে রাখতে চায় ক্যামেরায় চেট লাগা চেহারা, আলুথালু পােশাক, গরুর বাথান আর পাব্লিক সেন্টিমেন্টের একটা বেল্ড দরকার, উপস্থাপনা আকর্ষণীয় হবে। তার নিউজ এডিটর সবসময় এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে বলে, ’নিউজতো খালি খুন, ধর্ষণ আর মানুষের দুঃসময় দেখানোর কায়দা না, এটা বিনোদনও। কাজেই এন্টারটেইনমেন্ট থাকতে হবে। এমন একটা ক্লিপিং যেন হেডলাইন শুনেই মানুষ †সাজা হয়ে বসে’।
ক্যামরাম্যান কাঁকে ক্যমরা নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে এসেছে, দেয়ালে দশ বাই দশ ফ্রেমে বাঁধানো হামিদ আর তার বৌয়ের ছবি। কম বয়সে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান হওয়া স্বামীর একফালি দাম্ভিক চেহারা কি ফটোটায়? না এসব ডিটেইলে নজর দেয়া যাবে না, ভিক্টিমের দিকে পক্ষপাত ধাবিত হওয়ার মত বাক্যমালা সাজাতে হবে। মানুষ মরে গেলে তার মন্দ দিকে নিয়ে কথা সচরাচর ওঠে না।

উঠানের মুখে জমাট বাঁধা কালচে রক্ত বৃষ্টিতে ফ্যাকাশে, তার ওপর পুলিশের দাগিয়ে যাওয়া চক থেবড়ে জায়গাটা শাদা আর খয়েরী বর্ণ, ক্যামেরায় তার ছবি ধরা পড়ে, ভীড় করে থাকা লােকজনের দঙ্গল প্রথমে সরাতে হবে একটু। এই কাজতো জেনে বুঝেই এসেছে। দাঁত কামড়ে কিছুদিন পার করা আর কি, তারপর তারও সুদিন আসবে।

ক্যামরার কাজ ক্যামরাকে করতে হয়, লং শট নেয়া হয়, প্রােফাইলে ধরা কান্না কান্না মুখ, আছারি বিছারি চিৎকার বেবাইন্না দম আটকানো কথা বার্তা সব ধারণ করা হয়। মিনিট খানেকের নিউজ স্লটের জন্য আধা ঘন্টার শ্যুট! ক্যামেরার মতই নির্বিকার যান্ত্রিক মুখ ক্যামেরাম্যানের। সাংবাদিক কিছুটা আবেগপ্রবণ হয় পড়ে, হয়ে পড়ে নাকি আবেগ আরোপ করে বােঝা যায় না। হামিদের বৌ আর কাঁদে না। তার কথা শান্ত পুকুরের মত স্থির, চােখ নিচে মেঝেতে। কেউ তার সন্দেহের তালিকায় আছে কিনা সে বলে না। তারনিষ্পাপ স্বামীকে কে বা কারা এমন করতে পারে তা তার বােধগম্য হয়না বলে সে জানায়, সে এই নারকীয় ঘটনার বিচার চায়। বিচার চাইতে গিয়ে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, তার কথা দুমড়ে যায়।

তিন।

হামিদের বৌ আবার নিজের ঘরের দােতলায়, শ্লথ পায়ে, উঠে আসে যেন জাের নেই, যেন গায়ে জ্বর, যেন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত নির্দোষ আসামী। তার নােয়ানো মাথা, চারপাশে আত্মীয়রা, পাড়া প্রতিবেশী কােরাসে কথা বলে, কি বলে তার কানে ঢােকে না। সে তার পাটভাঙ্গা বিছানায় উপুড় হয়ে পরে থাকে। কেউ তাকে ডেকে নিয়ে যায় না। সে নিচের সরগরম বিকেলের আঁচ পায়, গরু ছাগলের, খড় বিচালির আওয়াজ পায়। দুপুর পার হয়ে সন্ধ্য বাগ দিতে থাকে ঘরের চৌকাঠে, ছাদের কার্ণিশে আকাশের পলায়নপর মেঘের ভেতরে। হামিদের বৌ লাইট জ্বালায়, নেভায়। নীল রঙ এর ডিম লাইট জ্বেলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত। তার নিজের বাসর রাতের কথা ভাবে। হামিদ চেয়ারম্যান মােবাইলে তুমুল গানটি বন্দী করে রেখেছিল তাকে দেখাবে এবং শােনাবে বলে, … ’হোয়াটস হার নেইম, হােয়াটস হার নেইম’ … কড়াইয়ে ফুটন্ত রসগোল্লার মত টুই টুম্বর সুখে ভেসে গিয়েছিল দুজন।

খবরের টাইম হয়ে গেছে। কিছু সময় গেলে পাশের বাড়ির টিভির আওয়াজ কানে আসে। প্রতিবেশী দু একজন গলা খাকারি দিয়ে সে বাড়িতে ঢােকে। শাশুড়িও চাদরে মাথা ঢেকে- ”অ বৗে, অ বৌ গেলাম” জানিয়ে পাশের বাড়ি গেলে হামিদের বৌ টিভির ম্রিয়মান আওয়াজে নিঃসাড় সন্ধ্যাকে থেতলে নিজের বিছানায় বসে থাকে।

মোবাইল বেজে উঠলে অচেনা নাম্বার তাকে দ্বিধাগ্রস্থ করে, রিপোর্টার মেয়েটা। নিউজে তাকে কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে তা বলে। তাদের আতিথেয়তায় তার মুগ্ধতা প্রকাশ বৌটার মন হাল্কা করলে সে একবার পাশের বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু ততক্ষণে চােষ কাগজের কালি শুষে নেয়ার গতিতে সংবাদ শেষ। আবারো কি দেখাবে? সদ্য নির্বাচিত, নতুন বিয়ে করা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গলা জবাই সহযোগে নিহত হলে সে সংবাদ কতবার দেখানো হয়? হামিদের বৗেয়ের ক্লান্ত বাসর রাত জড়ির মালাদুটোসহ খাটের বাজুতে ঝুলে থেকে বিদ্রুপ করে। মাসতিনেক আগে ইলেকশন জেতা বিজয়ী চেয়ারম্যান জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাতের তুমুল সাক্ষী করে বাঁধিয়ে রাখা ফটোও ব্যাঙ্গ করে হাসে। বৌটার স্বামীর গরবে গরবিনী হয়, বৌটার অহংকারে পা মাটিতে পরে না। তার অস্থির লাগে। বিদ্যুৎচমকের মত প্রচন্ড ভয় আর আতঙ্কের ক্রমাগত চাপে সে অশরীরি কােন আলখাল্লার ভেতরে সেধিয়ে থাকতে চায়, সেখানে নিরাপদ, সেখানে। কেউকি তাকে মাছ কাটতে বলে? মাছ কাটতে ভয় লাগে তার, শুধু ভয় না, ঘেন্নাও লাগে, মাছের রক্ত, গন্ধ সব মিলিয়ে এক বিবমিষাময় অনুভূতি লেপ্টে থাকবে বলে মনে হয়, তবু তার বিএ পাশ পাতের আঙ্গুল বড় রুই মাছের আঁশ ছাড়ায় ধা চক চক বাটিতে। এই মাছ নতুন বৌকে কাটতে হবে বৈকি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাে বলে কথা! তার চম্পক আঙ্গুলে জােরের অভাবে স্বামী হাসতে হাসতে এগিয়ে এসেছে। বাড়ি ভর্তি ঠাট্টা সম্পর্কের রসে সাঁতার দিয়ে দুজনের হাত মাছের মুড়োটা আলগা করতে পারলেই নতুন বৌয়ের দায়িত্ব শেষ।
আবার তার মােবাইলে মনঃসংযোগ করলে আবারো হােয়াটস মাই নেইম… ফিস ফিসিয়ে শাদাটে অনাবৃত বাহু দেখায়। এবার ঘরের পর্দা ঠেলে তার চাচী শাশুড়ী ঢােকে, তাকে খট করে ফােন বন্ধ করে দিতে হয়।

-’ কিরে আমাকে একটু মােবাইল করবার পারলানা? ফারজান আইসা কইলো তােম্যাক নাকি টিভিত দেখাইছে। খরবরত। আমাক একটু কইলে কি হইলো হয়? তােমাক একনা দেখতাম মা। বুড়ি হইয়া গেছি তাই তােমরা পােছেন না হামাক। তােমাক টিভিটার ভিত্রত কেমন দেখায় আমরা একনা দেখতাম না। কইলে কি হইল হয়?

হামিদের বৌ আর কী করে? চাচী শাশুড়ীকে বিছানার কােনে বসতে দেয়। মাথার ঘােমটা তুলে দেয়। তারপর কাঁদতে বসে। চাচী তখন ’আহারে আমার একরত্তি মেয়ারে, তাের কপালে এত দূর্গতি কের দিলরে আল্লা’ বলে নিজেও বিলাপ করে। তার বিলম্বিত কান্নার সঙ্গে চাচী শাশুড়ীর বিলাপ সঙ্গত করে। আরো দু একজন অচেনা মহিলা তার বিছানা ঘেষে দাঁড়ায় অশরীরীর মত স্থির থাকে। এরা করা? তার প্রয়াত স্বামীর বন্ধুবান্ধবের দারা পরিবার? কুশলাকাঙ্খী তাদের চােখ আর নরম চেয়াল। বৌটার বিরক্ত লাগে? মনযোগের এমন আয়োজন তাকে ঘিরে আর কখনো কি হয়েছে?

ঘরের ভেতরে নির্জনতা ফুরসত না পেয়ে হাঁপায়। চাচী শাশুড়ির কথার সঙ্গে দড়ি দিয়ে কথা বেধে যেতে থাকে। বৌটা তার মােবাইল নিয়ে নাড়া চারা করতে থাকলে সেটা বেজে ওঠে। এবার তার বান্ধবী- তার মন হাল্কা করতে হয়তো, কুশল বিনিময়ের শেষে স্কুলের দিনগুলিতে ফেরত ডেতে চায়- ’তোর মত এমন বেইমান দেখিনাই। টিভিতে কথা কইয়া ফেলাইলি আর আমাক একটা মােবাইল করলি না। আমি তাে দেখতামই না, খালি বজলু বাজার থেইকা দৌড়ায়া আসি খবর দিলো, তােক নাকি খবরত দেখাইতেছে… ইস কি ভাগ্য তোর ক দেখি?”

বান্ধবী ছেড়ে দিলে তার স্কুল শিক্ষিকা তাকে ফােন করে, ”তোমাক এইমাত্র আমরা টেলিভশনে দেখলাম, মনটা খারাপ হয়ে গেল, এত অল্প বয়সে বিধাব, আল্লাহ তার বেহেস্ত নসিব করুক। মা তুমি স্কুলে বেড়াতে আসিও…

ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার তার ফােন নম্বার যােগাড় করে ফেলেছে- ’ভাবী আপনাকে সােনিয়া গান্ধীর মত হইতে হবে। আপনাকে আমরা আগামী ইলেকশনে নমিনেশন দিবো। ভাবী আপনার আজকে যে পাব্লিসিটি হইছে আর বশী কিছু লাগবে না। আপনে খালি ভােট কেন্দ্রের সামনে যায়া খাড়াবেন…’ হামিদের বউয়ের মাথায় ঘােমটা যায়, পিঠ সােজা তার শিরদাড়া অকষ্মাৎ শক্ত।

ঢাকার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধির ফোন বাজে, ”ভাবী টেলিভিশনে যে কথাগুলো বললেন তা আমাদের কাগজে নিউজ করে পাঠায়া দিতেছি। খুব ভাল বলছেন ভাবী। সাহস রাখবেন, আমরা আছি আপনার পাশে’।

বৌটা ক্রমাগত মােবাইল কানে চেপে থাকে। তার ডান গালের পাশে কান লালচে হতে থাকে। তার বিমর্ষ, শােকার্ত, শংকিত চেহারায় একটা ধোঁয়াটে ভাব, সেখান থেকে চিলতে হাসি ছড়িয়ে যায় মেঝেতে পাতা তার দৃষ্টির সমান্তরালে।

পেইন্ট: ফরিদা জামান

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here